নিষেধাজ্ঞায় অবরুদ্ধ মৎস্যজীবি পরিবারে মানবেতর অবস্থা

প্রথম পাতা » পটুয়াখালী » নিষেধাজ্ঞায় অবরুদ্ধ মৎস্যজীবি পরিবারে মানবেতর অবস্থা
মঙ্গলবার ● ৬ জুন ২০২৩


নিষেধাজ্ঞায় অবরুদ্ধ মৎস্যজীবি পরিবারে মানবেতর অবস্থা

জাহিদ রিপন, পটুয়াখালী সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥

কয়েক দফা মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা আর নানা আইনী প্রতিবন্ধকতার বেড়াজালে বন্ধী হয়ে পড়েছে পটুয়াখালীর উপকূলীয় জেলেদের জীবন। পুঁজি হারানোর শংকায় পড়েছে আড়ৎদার, ট্রলার মালিকরা। বছরের অধিকাংশ সময় মাছ শিকার করতে না পারায় মৎস্যখাতে নিয়োজিত শ্রমিকরাও পার করছে মানবেতর জীবন। পেশা ও পুঁজির নিশ্চয়তায় সময়োপযোগী এবং জেলে ও ব্যবসা বান্ধব মৎস্য শিকার নীতিমালা প্রনয়নের দাবী সংশ্লিস্টদের।
পটুয়াখালীতে ৬৭ হাজার ৬শ’ ৮০ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। অনিবন্ধিত জেলে রয়েছে আরো প্রায় ২৫ হাজার। বঙ্গোপসাগর এবং জেলায় প্রবাহমান বিস্তীর্ন নদী ও খালকে উপজীব্য করে জীবিকা নির্বাহ করে পটুয়াখালীর আরো অন্তত: ২০ হাজার মানুষ। দারিদ্রতা, অভাবকে সঙ্গী করে কস্টসাধ্য এ পেশায় এসব জেলেদের সম্পৃক্ততা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। রোদ-বৃস্টি-শীত, ভয়কে উপেক্ষা করে গভীর সমুদ্র আর খরস্্েরাতা উত্তাল নদীতে সারা বছর মাছ শিকার করে জোগান দেয় দেশের আমিষের চাহিদার। বিনিময়ে পরিবারের তিন বেলা খাবার আর ভরনপোষন জোগান দেয়। নন্যুতম বিলাসিতা এসব জেলেদের কাছে দু:স্বপ্ন। কিন্তু গত এক দশকে মাছ শিকারের উপড় বেশ কয়েকটি নিষেধাজ্ঞা ও আইনী প্রজ্ঞাপন এসব জেলেদের পেশা ও জীবিকাকে করেছে তুলেছে আরো সংকটময় ও ঝুঁকিপূর্ন।
দখিনের সবচেয়ে বড় মাছের মোকাম আলীপুর-মহিপুর-কুয়াকাটায় গভীর সমুদ্র থেকে মৎস্য অরোহনকারী তালিকাভূক্ত জেলে রয়েছে ৭ হাজার ৪ জন। এদের মধ্যে মহিপুরে ২২২৪ জন, আলীপুরে ২২৯২ জন এবং কুয়াকাটায় ২৪৮৮জন। গভীর সমুদ্র এবং প্রধান নদীগুলো থেকে মৎস্য শিকারের জন্য এ বন্দরের আওতায় ট্রলার রয়েছে মহিপুরে ৮শ’ টি, আলীপুরে ৬শ’ টি, কুয়াকাটায় ৬৫৮টিসহ মোট ২০৫৮টি। আহরিত মৎস্য নির্ভর করে আড়ৎ গড়ে উঠেছে মহিপুরে ৮১টি, আলীপুরে ১১৩টি, কুয়াকাটায় ৪২টিসহ মোট ২৩৬টি। ট্রলার থেকে মাছ এসব আড়তে নিয়মিত শ্রমিক রয়েছে মহিপুরে ৮৪১জন, আলীপুরে ১ হাজার, কুয়াকাটায় ১১২ জনসহ মোট ১৯৫৩ জন। এছাড়াও জেলার উপকূলীয় উপজেলা গলাচিপা, দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালী, দশমিনা, বাউফল, দশমিনা, মির্জাগজ্ঞের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য মাছের আড়ৎ। তথ্য আলীপুর-মহিপুর-কুয়াকাটা মৎস্য ব্যবসায়ীদের।
ইলিশসহ সামুদ্রিক ও মিঠাপানির মাছ ধরার প্রধান মৌসুম শুরু হয় বৈশাখ থেকে। মৌসুমের শুরুতেই বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ও জীব-বৈচিত্রের বাঁধাহীন প্রজনন, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা, প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ রাখতে দ্বিতীয় দফায় ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মৎস্য বিভাগ। এসময়ে সারা দেশে ইলিশ মাছ আহরন, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরন, অথবা ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
নভেম্বর হতে জুন পর্যন্ত ৭ মাস জাটকা ধরা, ক্রয়-বিক্রয়, মজুদ ও পরিবহন নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। এছাড়াও জেলার চর রুস্তুম হতে ভোলা জেলার ভাদুরিয়া পর্যন্ত তেতুলিয়া নদীর ১০০ কিলোমিটার মার্চ থেকে এপ্রিল এবং জেলার কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার নভেম্বর থেকে জানুয়ারী পর্যন্ত মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা অরোপ করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। এসময়ে এই দুই নদীতে সকল প্রকার মাছ আহরন, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরন, ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে সরকার। তথ্য মৎস্য অধিদপ্তরের।
মৎস্য অফিস জানায়, আবরোধ বা মাছ শিকার নিষিদ্ধকালীন সময়ে তালিকাভূক্ত বেকার জেলে প্রতি ২২ দিনের জন্য ২০ কেজি চাল। ৬৫ দিনের জন্য ৮৬ কেজি চাল। জেলার ২টি অভায়াশ্রম নদীতে ৩ মাস মাছ শিকার না করার জন্য সংশ্লিস্ট জেলেদের ৪০ কেজি চাল এবং জাটকা ধরা থেকে বিরত থাকলে জেলে প্রতি ১৬০ কেজি করে চাল সরকারীভাবে প্রনোদনা হিসাবে দেয়া হচ্ছে।
প্রনোদনার প্রদেয় এ চালের তালিকা প্রস্তত এবং বিতরন নিয়ে জেলেসহ ট্রলার মালিক ও অড়ৎদারদের রয়েছে ক্ষোভ। ক্ষোভ রয়েছে চাহিদার বিপরীতে সামান্য চাল দেয়া, নিবন্ধিত জেলে তালিকা নিয়ে। জেলেরা অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বজনপ্রীতির সুযোগ নিয়ে মটোরসাইকেল, ভ্যান, ইজিবাইক চালক, কৃষক, রাজনৈতিক দলের কর্মীরা জেলে হিসাবে তালিকাভূক্ত হয়েছে। প্রকৃত জেলেরা সাগর, নদীতে মাছ শিকারে ব্যস্ত থাকায় এবং তালিকাভূক্তি সম্পর্কে যথাযথ ধারনা এবং খবর না থাকায় তাদের বড় একটি অংশ তালিকাভূক্ত হতে পারেনি। নতুন যারা জেলে পেশায় সম্পৃক্ত হয়েছে তারাও তালিকাভূক্ত হয়নি। তাই তালিকা হাল নাগাদ এবং প্রকৃত জেলেদের নাম তালিকাভূক্ত করার দাবী তাদের। তবে জেলেদের বড় একটি অংশ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রনোদনা নয়, আইনী খরগমুক্ত স্বাধীন মৎস্য শিকার পেশা ফিরে পেতে চান।
সময়োপযোগী এবং জেলে বান্ধব নয়, শুরু থেকেই জেলে ও ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগ রয়েছে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা নিয়ে। এসময় প্রতিবেশী ভারতের জেলেরা নির্বিঘেœ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় প্রবেশ করে অবাধে শিকার মাছ করছে। এমন অভিযোগ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে জেলেদের। যদি অবরোধ দিতেই হয় তবে ভারতের সাথে একই সময়ে তা পালনের জন্য জোড় দাবী জেলেদের।
জেলেদের সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ জাটকা সংরক্ষন আইন এবং তার প্রয়োগ নিয়ে। ২৫ সেন্টিমিটার বা ১০ ইঞ্চির নিচে ইলিশকে জাটকা হিসাবে গন্য করা হয়। আড়ৎদার মনিরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নভেম্বর হতে জুন পর্যন্ত ৭ মাস জাটকা ধরা হতে বিরত থাকতে বড় ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়। এসব জালে মাঝেমধ্যে জাটকা ধরা পড়ে। ধৃত জাটকা ফেলে দিয়ে আড়তে নিয়ে আসি। তখন জেল, জরিমান, মাছ জব্দসহ নানা আইনী ঝামেলায় পড়তে হয়। ফলে অনেক জেলে এসময়ে মাছ শিকার করতে চায়না।
অবরোধকালীন সময়ে প্রকৃত জেলেরা সরকার, আড়ৎদার কিংবা কোম্পানী থেকে কোন সাহায্য পায়না উল্ল্যেখ করে মাঝি শাহ-আলম বেপারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, অবরোধকালীন সময়ে ভারতীয় জেলেরা অবাধে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে চিকন ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ ধরে নিয়ে যায়। আমরা যখন শিকারে বের হই, তখন সাগরে মাছ নাই। তিনি আরো বলেন, শিখেছি মাছ শিকার করা। কৃষি কাজ জানিনা। অন্য কোন পেশারও অভিজ্ঞতাও নাই। তাই অবরোধকালীন সময়ে অন্য কাজ করতে পারিনা। সাময়িক সময়ের জন্য কেউ কাজেও নিতে চায়না।
ভোলার চরফ্যাশনের দুলাহাট এলাকার ইলিশ শিকারী জেলে আবুল কালাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, অবরোধকালীন সময়ে বেকার দিন কাটাই। পরিবার নিয়ে অভূক্ত থাকতে হয়। আশায় থাকি কবে শেষ হবে অবরোধ। মাছ ধরব। বিক্রি করে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেব। কিন্তু সময় যায়, ধারকর্য আর দেনাই বাড়ে। অবরোধ শেষ হয়না। চাল তো পাইনা। চেয়ারম্যান, মেম্বররাও খোঁজ নেয়না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোম্পানী দেখবে কি? তাদের নিজের চালানই তো টিকেনা।
ভোলার চরফ্যাশন এলাকার তছির মাঝি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২ যুগ মানুষের ট্রলারে কাজ করেছি। সাচ্ছন্দ্য আর সাবলম্বীতার আশায় সকল সম্বল আর ধারদেনা, দাদন নিয়ে নিজে একটি ট্রলার গড়েছি। এখন প্রতি বছর দেনা বাড়ছে। ট্রলার বিক্রি করেও সে দেনা শোধ হবেনা। তিনি আরো বলেন, দেনা, দাদান আর লোকসানের বোঝা বইতে বইতে অনেক ট্রলারমালিক ট্রলার বিক্রি করে দিয়েছে। যেসব জেলেরা এসব ট্রলারকে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করত, তারা কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
আলীপুরের নুরু মাঝি বলেন, গত এক দশকে অবরোধ আর আইনী মারপ্যাচে আয়ের অনিশ্চয়তায় অনেক জেলে পেশা পরিবর্তন করছে। এর প্রভাব দখিন বিশাল মৎস্যখাতে পড়তে শুরু করেছে।
অবরোধকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি মানবেতর অবস্থায় পড়ে মৎস্য আড়তে কাজ করা শ্রমিকরা। মহিপুর মৎস্য মার্কেটের শ্রমিক মোতালেব দেশ রূপান্তরকে বলেন, জেলেদের জন্য বরাদ্ধ থাকলেও আড়তে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য কোন প্রনোদনা নাই। ফলে পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন পার করতে হয়।
নামে আছে মাছের আড়ৎ কিন্তু মাছও নাই, কাজও নাই। ধ্বংসের শেষপ্রান্তে জেলে ও মৎস্য ব্যবসা। এমন আক্ষেপ করে মহিপুর মৎস্য বন্দরের গাজী ফিশের মালিক মজনু গাজী বলেন, বৈশাখ থেকে শ্রাবন বর্ষার এই চার মাস ইলিশ মাছ শিকারের পূর্নাঙ্গ সময়। কিন্তু মৌসুমের শুরুতেই সামুদ্রিক মাছের প্রজনেনর জন্য ৬৫ দিন, মা ইলিশ প্রজননেনর জন্য ২২দিন। এরপরে মাত্র ৬৫ দিন মাছ শিকার করা যায়। বৈরি আবহাওয়ার কারনে প্রায় ২০-২৫দিন মাছ শিকার বন্ধ রাখতে হয়। ফলে মূল ইলিশ মৌসুমে জেলেরা মাত্র ৪৫ দিন মাছ ধরতে পারে। কার্তিক থেকে পৌষ এই তিন মাসকে এই শীতের মৌসুম বিবেচনা করা হয়। তখন সাগরে কিংবা নদীতে তেমন মাছ মেলেনা। আবার ফাল্গুন-চৈত্র ২ মাস জেলেরা মাছ ধরেনা।
আলীপুর-কুয়াকাটা ট্রলার ও আড়ৎ মালিক সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে ঘন ঘন প্রাকিৃতক দুর্যোগ আগাত হানছে গভীর সাগরে। ২০২১ সালে ১০৭ দিন, ২০২২ সালে ১১৮দিন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে সমুদ্রে প্রবেশ করতে পারেনি জেলেরা। এসব বিবেচনায় নিয়ে অবরোধ দেয়া উচিৎ। পাশাপাশি নিষিদ্ধ জাল উৎপাদন, বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারকারী জেলে-ট্রলার-আড়ৎ মালিকদের কালোতালিকাভূক্ত করা এবং ট্রলিং ফিশিং বন্দ করলেই মাছের প্রচুর উৎপাদন বাড়বে। মাছ ধরা বন্দ করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়।
কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা সাগরকন্যাকে বলেন, মাত্র ২২দিন সারা দেশে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হচ্ছে। অবরোধকালীন সময়ে জেলেদের যে প্রনোদনার চাল দেয়া হচ্ছে তা অপ্রতুল। এটি বাড়ানোর জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

জেআর/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২০:৪৯:০৩ ● ৯৬ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ