জালনোট কারবারি দমনে নতুন আইনের উদ্যোগ

প্রথম পাতা » জাতীয় » জালনোট কারবারি দমনে নতুন আইনের উদ্যোগ
শুক্রবার ● ৮ মার্চ ২০১৯


জালনোট কারবারি দমনে নতুন আইনের উদ্যোগ

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

সরকার দেশে দেশী-বিদেশী জালনোট কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে দেশের জাল নোট কারবারীরা ধরা পড়লেও স্বল্পসময়ের মধ্যে তারা জামিনে বেরিয়ে পুনরায় একই ব্যবসায় লিপ্ত হচ্ছে। সম্প্রতি গোয়েন্দারা অভিযানে কেরানীগঞ্জের একটি ভবনের ফ্ল্যাটে জাল মুদ্রা তৈরির কারখানার সন্ধান মিলে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন ধরনের অন্তত কুড়িটি কারখানা ছড়িয়ে রয়েছে। আর দেশের জাল টাকা ছড়িয়ে দিতে অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। ওসব কারখানায় শুধু দেশী টাকা নয়, ভারতীয় রুপীসহ বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা তৈরি করছে ওই সিন্ডিকেট। ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশ-বিদেশে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানেও তা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ওসব জাল নোট কারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ’ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিদ্যমান আইনের দুর্বলতায় দেশে জাল নোটের বিস্তার ঘটছে। বিগত ৩ বছরে প্রায় ৩ কোটি টাকার জাল নোট শনাক্ত হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের তথ্যানুযায়ী রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় জাল নোট তৈরিতে কাজ করছে অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রুপ। মূলত বছরের দুটি ঈদ ও পূজাকে কেন্দ্র করে বেড়ে যায় জাল নোট চক্রের ব্যস্ততা। দক্ষ কারিগরদের তৈরি জালিয়াত চক্রের নিখুঁত জাল টাকাতেও নিরাপত্তা সুতা বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ফলে সাধারণ চোখে সেগুলোকে জাল বলে ধরার কোন সুযোগই নেই। এমন অবস্থায় জাল নোট নিয়ন্ত্রণে নতুন খসড়া আইনে কোন ব্যক্তির কাছে পরপর তিনবার ৫শ’ পিসের বেশি যে কোন মূল্যমানের জাল নোট পাওয়া গেলে তাকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদ- বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত করার বিধান রাখা হচ্ছে। তবে প্রথমবার একই সংখ্যক জাল মুদ্রা পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদ- বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত করা হবে। দ্বিতীয়বার একই ব্যক্তির কাছ থেকে তা পাওয়া গেলে তাকে সর্বোচ্চ ১২ বছরের কারাদ- বা আর্থিক জরিমানা প্রথমবারের তুলনায় দ্বিগুণ অথবা উভয় দ- দেয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০১৮ সালে জাল নোট সংক্রান্ত ১৩৩টি মামলা হয়েছে। তার আগে ২০১৭ সালে ২৮৭টি, ২০১৬ সালে ৩৪৪টি, ২০১৫ সালে ৪১০টি এবং ২০১৪ সালে ৩৬৮ মামলা হয়েছে।
সংশি¬ষ্টরা জানান, জাল নোটের কার্যক্রম প্রতিরোধ এবং ওই সংক্রান্ত বিচারের জন্য পৃথক কোন আইন দেশে কার্যকর নেই। ফলে দ-বিধি ১৮৬০-এর ৪৮৯(ক)-(ঘ) ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ২৫(ক) ধারা অনুযায়ী জাল নোট সংক্রান্ত অপরাধের বিচার চলছে। কিন্তু ওসব আইনে বিচার করতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশেষ করে বিচারকালে শুনানির নির্ধারিত দিনে প্রায় সময়ই সাক্ষী উপস্থিত না থাকায় মামলার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নিরপরাধ হওয়া এবং মাত্র কয়েক পিস জাল মুদ্রা পাওয়া কঠোর শাস্তি ভোগ করছে। এমন অবস্থায় সব দিক ভেবে সরকার দেশে প্রথক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। পৃথক ওই আইন প্রণয়নের জন্য ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর জাল নোট প্রচলন প্রতিরোধ সংক্রান্ত কমিটির সভায় ৬ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি আইনের খসড়া প্রণয়ন ও চূড়ান্ত করে। সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্র জানায়, প্রতিটি উৎসবের আগ মুহূর্তে জাল নোট তৈরির চক্রগুলোর মধ্যে ভেজাল টাকা নিখুঁত করার বিষয়ে প্রতিযোগিতা চলে। কারণ যে চক্রের টাকা যত নিখুঁত, তার টাকার দাম তত বেশি, বিক্রিও বেশি। এক লাখ টাকার বান্ডেল ১২ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। জাল নোট চক্রের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে জাল টাকাসহ আটকও হয়েছে। তবে তাদের অধিকাংশই জামিনে বেরিয়ে আবার একই পেশায় জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু নতুন আইনটি পাস হলে তা হবে দেশে জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে প্রথম আইন। আইনটি বাস্তবায়নে জাতীয় এবং জেলা পর্যায়ে কমিটি থাকবে। কমিটির সিদ্ধান্ত বান্তবায়নে আইনের আওতায় গঠন করা হবে জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সেল। নতুন আইনে জাল নোট সংক্রান্ত খবর দেয়া হলে সংবাদদাতাকে পুরস্কার দেয়ার বিষয়েও বিধান থাকছে। জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইনের খসড়ায় অপরাধীদের জন্য পর পর তিন দফা শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। প্রথমবার অপরাধ করে শাস্তি ভোগ করলে দ্বিতীয়বার একই অপরাধে শাস্তি হবে প্রথমবারের তুলনায় দ্বিগুণ। আর একই ব্যক্তি তৃতীয়বার ওই অপরাধ করলে দ-ের পরিমাণ দ্বিগুণ ও সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন।
সূত্র আরো জানায়, নতুন আইনের খসড়ায় দ-বিধিতে বলা হয়, জাল নোটের সংখ্যা ৫শ’ পিসের (যে কোন মূল্যমানের) কম হলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদ- বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- হবে। একই ব্যক্তির কাছ থেকে একই পরিমাণ নোট (৫শ’ পিসের কম) দ্বিতীয়বার পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদ- বা ১০ লাখ টাকা অথবা উভয় দ- হবে। একই ব্যক্তির কাছে তৃতীয়বার (৫শ’ পিসের কম) পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদ- বা ৫০ লাখ টাকা আর্থিক দ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবে। তবে যে কোন মূল্যমানের জাল নোট একশ পিসের কম পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদ- বা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। যদি একই ব্যক্তির কাছে দ্বিতীয়বার একই পরিমাণ নোট (একশ’ পিসের কম) পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদ- বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- হবে। তৃতীয়বার একই ব্যক্তি একই পরিমাণ (একশ’ পিসের কম) জাল নোট নিয়ে ধরা পড়লে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ- বা ২০ লাখ টাকা দ- অথবা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে।
এদিকে নতুন আইনের খসড়াটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লিগ্যাল রিটেনার এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ দিয়ে ২০১৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ভেটিং সম্পন্ন করা হয়েছে। গত বছরের ২৬ অক্টোবর সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থাপন করা হয়। খসড়াটি আইনে রূপান্তর করতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। নতুন আইনে জাল মুদ্রা প্রস্তুত, ক্রয়-বিক্রয়, খাঁটি বলে ব্যবহার ও লেনদেন, প্রতারণার উদ্দেশ্যে নিজের দখলে রাখা, দেশ থেকে বিদেশ বা বিদেশ থেকে সরবরাহ, পরিবহন ও পাচার, অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বিতরণ অপরাধ বলে গণ্য হবে। তাছাড়া জাল মুদ্রা তৈরির জন্য যন্ত্রপাতি বা উৎপাদন বা দ্রব্যাদি প্রস্তুত, সরবরাহ, আমদানি, মেরামত, বাহন ও ক্রয়-বিক্রয়ও অপরাধ। মুদ্রা তৈরি সংক্রান্ত পদ্ধতি, তথ্য আদান-প্রদান, ফাইল ক্লিপ, হার্ডডিস্ক, এ সংক্রান্ত কোন গুজব ছড়ানো ওই আইনের আওতায় অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
অন্যদিকে নতুন আইনটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থ সচিবের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। ওই কমিটিতে এফআইডির অতিরিক্ত সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকসহ স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (যুগ্ম-সচিব), উপ-পুলিশ পরিদর্শক, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের পরিচালক এবং এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রতিনিধি থাকবেন। তাছাড়া জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে পৃথক আরো একটি জেলা কমিটিও গঠন করা হবে। আর উভয় কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সেল গঠন করা হবে। তার প্রধান হবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের সংশ্লিষ্ট ডেপুটি গবর্নর। সেল থেকে অন্যান্য দেশে এ ধরনের আইনের কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক ও মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান জানান, জাল টাকা তৈরি, বিস্তার ও বিক্রি রোধে র‌্যাব সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে র‌্যাবের গোয়েন্দা টিম, মোবাইল কোর্ট ও টহল টিম রাতদিন কাজ করছে।
একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম জানান, এবার জাল নোট কারবারিদের কঠোরভাবে দমন করতে নতুন আইন করা হচ্ছে। তা হলে জাল নোট কারবারীদের সহজেই জামিন পাওয়া বন্ধ এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। বিদ্যমান অন্য আইনে জাল নোটের মামলার বিচারে অনেক সময় লাগছে। ওই কারণে অপরাধীদের শাস্তি দেয়া যাচ্ছে না।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ১৬:৫০:১৮ ● ৫০৩ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ