ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানির জন্য উদ্দীপক সুবিধা প্রদানের কথা ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটশিল্প টেকসই করতে এ খাত লাভজনক করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পাট এমন একটি পণ্য যে তার কিছুই ফেলা যায় না। সেটার কেন লোকসান হবে। আমরা লোকসান শুনতে চাই না। এটাকে লাভজনক কীভাবে করা যায়, কীভাবে করতে হবে- সেটা দেখতে হবে।
জাতীয় পাট দিবস উপলক্ষে বুধবার (৬ মার্চ) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রয়োজন কী, চাহিদাটা কত- সেটাও আমাদের বের করতে হবে। নতুন নতুন পণ্য বের করে অবশ্যই এটাকে আমরা লাভজনক করতে পারব। এটা আমি বিশ্বাস করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষিজাত পণ্য হিসেবে পাট পণ্য একটি প্রণোদনা পেতে পারে। আবার রপ্তানিমুখী পণ্য হিসেবেও পাটজাত পণ্য প্রণোদনা পেতে পারে। পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে একে ব্র্যান্ডিং করতে হবে। তাহলে বিরাট মার্কেট আমরা পেয়ে যাব এবং এতে পাট থেকে আরও ব্যাপকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। বিএনপির আমলে পাটশিল্পকে নিরুৎসাহিত করার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি ‘হতাশ পার্টির’ সঙ্গে নেই; সব সময় তিনি আশাবাদী। পাট খাতের সম্ভবনার কথা তুলে ধরে এবং করণীয় বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এত হতাশ হওয়ার কী আছে? লোকসান, লোকসান করবো কেন? আমি হতাশ পার্টির সঙ্গে না, আমি সব সময় আশাবাদী। আমি মনে করি আমাদের দেশের পাটের প্রতিটি জিনিসই কাজে লাগে।
তিনি বলেন, নতুন পাটজাত পণ্য আবিষ্কার করে এটাকে আমরা অবশ্যই লাভজনক করতে পারবো-এটা আমি বিশ্বাস করি। পাটের সোনালী দিন আবার ফিরিয়ে আনতে পারবো বলে মনে করি। পাটের বহুমুখী ব্যবহারের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, পাটের কোনো কিছুই ফেলা যায় না। পাটের পাতা- এটা ভালো সবজি। পাট শাকে আয়রণ বেশি, পাট শাক ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি, জ¦রসহ নানা ধরনের রোগের প্রতিষেধক; আবার পাটের পাতা মাটিতে পড়লে সেখানকার উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এখন অবশ্য পাটের চা-ও আবিষ্কার হয়েছে। পাটখড়ির মূল্য আছে। পাটখড়ি থেকে ফার্নিচার হচ্ছে, জ¦ালানিসহ বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে পাটখড়ির। পাটের কোনো কিছুই ফেলা যায় না। এর সব কিছুই কাজে লাগে। পাটের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাট আমাদের একটি কৃষি পণ্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাট আমাদের শিল্পের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পাট আমাদের রপ্তানি যোগ্য পণ্য। এই পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে একসময় পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তার সিংহ ভাগ রপ্তানি আয় আসতো এই পাট থেকে।
কৃত্রিম তন্তু পাটের বাজারকে একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ এখন পরিবেশ সর্ম্পকে যথেষ্ট সচেতন, যেটি আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে পরিবেশবান্ধব পণ্য পাট। এর বিরাট সম্ভাবনা আমাদের সামনে আছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাটগাছের ভূমিকার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবচেয়ে বেশি কার্বন শোষণ করে পাট ক্ষেত। এদিক থেকেও পরিবেশ রক্ষায় বিরাট অবদান রাখে। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিনের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশে পাটের তৈরি সম্ভবনাময় ‘সোনালী ব্যাগ’ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সোনালী আঁশ পাট-যার থেকে সোনালী ব্যাগ থেকে অন্যান্য পণ্য হচ্ছে এটাকেও আরো বেশি ব্র্যান্ডিং করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে। তাহলেই বিরাট মার্কেট আমরা পেয়ে যাবো।
পাট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আরও ব্যাপকভাবে অর্জন করা যাবে। তিনি বলেন, পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প তৈরি করা হয়েছে। এটি মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। এটি পলিথিনের মতো সমস্যা সৃষ্টি করবো। এটা যদি আরও ব্যাপকভাবে উৎপাদন করতে পারি বিদেশে রপ্তানি করতে পারবো এবং নিজেদের দেশেও ব্যবহার করতে পারি। এটি পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে যথেষ্ট কাজ লাগে। আর সোনালী ব্যাগের উৎপাদন আমাদের আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। আগে যাদের পাটের মিল ছিল তারা হতাশ ছিলেন। এখন আবার আস্তে আস্তে তারা উৎসাহিত হচ্ছেন। আমি চাই আরও উদ্যোক্তা এগিয়ে আসুক। যেসব পাটকল এখনো পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে, প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে সেগুলো চালানোর কথাও অনুষ্ঠানে বলেন সরকারপ্রধান।
পাটপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে নতুন বাজার খোঁজার পাশাপাশি পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, এই সোনালী আঁশ আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পাটকে আরও কীভাবে আমরা কাজে লাগাতে পারি সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে পাটের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাট আমাদের এমন একটা পণ্য, যুগ যুগ ধরে যার জন্য সংগ্রাম হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বা ৭০ এর নির্বাচনেও পাট ও পাট পণ্যের কথা এসেছে। ৭৫ এরপর যা হয়েছে তা সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। সেই সময় যারা ক্ষমতায় এসেছিল.. যারা সংবিধান লংঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছিল.. তাদের মধ্যে একটা বৈমাত্রেয় আচরণ পাটের প্রতি ছিল। তারা যেন পাট শিল্পটাকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। অথচ এটা ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ।
শেখ হাসিনা বলেন, পাট ও পাটপণ্যকে আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে এ কারণে যে, এর সাথে কৃষক জড়িত। আমাদের দেশের মানুষের ভাগ্য জড়িত। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মির্জা আজমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পাটখাতের উন্নয়নে অবদান রাখা সেরা ১৪ জনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- এ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মির্জা আজম, সচিব মো. মিজানুর রহমান। পরে প্রধানমন্ত্রী পাটপণ্য মেলা ঘুরে দেখেন। মেলায় প্রধানমন্ত্রী পাটের সোনালী আঁশ দিয়ে তৈরি ‘সোনালী ব্যাগ’সহ বিভিন্ন পণ্য হাতে নিয়ে দেখেন। দুই দিনব্যাপী এ মেলা সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকছে। মেলায় পাটের সুতোয় তৈরি শাড়ি, অন্য পোষাক, দাবা খেলার ঘর, ভ্যানিটি ব্যাগসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, জুতো, ফুলদানি, পাটের চা, রূপচর্চার সামগ্রী, পাট থেকে উন্নত তন্তু, সোফা, টুল, টেবিল, ট্রে, ঝুড়ি, ডাস্টবিন, গৃহসজ্জার বিভিন্ন সরঞ্জামসহ দৃষ্টি নন্দন, পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন পাট ও পাটজাত পণ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।
এফএন/এমআর