ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) কল। অবৈধপথে কল আদান-প্রদানের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে অভিযান চালাচ্ছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি) ও র্যাবের যৌথ টিম। তবে কোন কিছুই যেন কাজে আসছে না। বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বিটিআরসির তথ্যানুযায়ি প্রতিদিন আড়াই কোটি মিনিট কল অবৈধ পথে আসছে। কিন্তু বাস্তবে এর পরিমাণ আরো বেশি। তিন বছর আগেও যেখানে অবৈধ ভিওআইপির পাশাপাশি বছরে আন্তর্জাতিক কল থেকে সরকারের রাজস্ব এসেছে ২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। সেখানে গত অর্থবছওে তা নেমে এসেছে অর্ধেকেরও কমে। এই বছরে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৯০৫ কোটি টাকা। অথচ বৈধপথে আন্তর্জাতিক কল বাড়াতে কমানো হয়েছে ইনকামিং কল টার্মিনেশন রেট। এমনকি অবৈধ কল টার্মিনেশনে অনিবন্ধিত সিম ব্যবহার হচ্ছে জানিয়ে বায়োমেট্রিক (আঙুলের ছাপ দিয়ে) সিম নিবন্ধন চালু করেছে সরকার। কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বৈধপথের সাথে পাল্লা দিয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে অবৈধ ভিওআইপি কল। আর এ খাতে প্রতিবছর প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর সরকার হারাচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈধ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা পরিচালনাকারী ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইআইজি) অপারেটররা। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম ৯ বছরে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭৪৪ কোটি ২১ লাখ ১২ হাজার ১০২ টাকা। তবে ওই খাত থেকে এখন প্রতিনিয়ত আয় কমছে। সর্বশেষ অর্থবছরে মাত্র ৯০৮ কোটি টাকা রাজস্ব এসেছে। অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়িরা দৈনিক মাত্র এক লাখ সিম ব্যবহার করলেও বছরে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
সূত্র জানায়, অবৈধ ভিওআইপির বিরুদ্ধে বিটিআরসি ও র্যাবের প্রতিটি অভিযানেই মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর বিপুল পরিমাণ সিম জব্দ করা হয়। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর এখন বায়োমেট্রিক ছাড়া সিম বিক্রি হওয়ার কথা নয়। তারপরও প্রতিটি অভিযানে এত বিপুল সংখ্যক সিম জব্দ করা হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ওসব সিম কিভাবে অবৈধ ব্যবসায়িদের কাছে যায়? বিগত ২০১৮ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে পরিচালিত দুটি অভিযানে দেখা গেছে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় দেশের মোবাইল অপারেটরদের সিম ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ওসব অভিযানে পাওয়া প্রায় ৫৩ হাজার সিমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে টেলিটক ও রবি’র সিম। ওই দুটি অপারেটরের যথাক্রমে ২১ হাজার ১৮টি এবং ২০ হাজার ৭০৯টি সিম পাওয়া গেছে। বাংলালিংক ও গ্রামীণ ফোনের পাওয়া গেছে যথাক্রমে ৬ হাজার ৬০২টি এবং ৪ হাজার ৬৪৭টি সিম। আর মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যানুয়ায়ি, ২০১৭-১৮ বছরে ২৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে বিটিআরসি ও র্যাব। ওসব অভিযানে ১৫ হাজার ৪৭৬টি সিম জব্দ করা হয়েছে ও ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৩১৮টি সিম বন্ধ করা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, অবৈধি ভিওআইপি রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিটি অভিযানেই বেশকয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে কিছু দিনের মধ্যে তারা বেরিয়ে এসে আবারো একই ব্যবসায় জড়িত হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ ভিওআইপির আড়ালে যেসব রাঘব-বোয়াল রয়েছে, তারা সব সময় ধরাছোয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে তেমন কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। সম্প্রতি সরকার-ঘোষিত অভ্যন্তরীণ মোবাইল কল রেট সর্বনিম্ন প্রতি মিনিট ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক আন্তঃগামী কল রেটের যে হিস্যা মোবাইল অপারেটররা পায়, তার মূল্য প্রতি মিনিট প্রায় ৩৩ পয়সা। তাতে আন্তর্জাতিক আন্তঃগামী কলের চেয়ে অভ্যন্তরীণ কলের আড়ালে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে দেশের অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা আরো বেগবান হচ্ছে।
এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ও র্যাব বিগত ১৪ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলার ২৬টি স্থাপনায় অভিযান চালিয়েছে। অবৈধ ভিওআইপি অভিযানে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের ৪২ হাজার ১৫০টি সিম ও প্রায় ১ কোটি ২৩ লক্ষাধিক টাকা মূল্যমানের অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। তাছাড়া বিটিআরসি অবৈধ ভিওআইপির অভিযোগে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের ৭৭ হাজার ৫৯০টি সিম বন্ধ করে দেয়। অবৈধ ভিওআইপি অভিযানের অংশ হিসেবে সিডিআর এনালাইজার এবং জিও-লোকেশন ডিটেকশন সিস্টেমের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহারের অপরাধে টেলিটকের ৭৭ হাজার ৫৯০টি শনাক্ত হয় এবং বন্ধ করে দেয়া হয়। আর অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন প্রতিরোধে চলমান অভিযানের অংশ হিসাবে সিডিআর এনালাইজের মাধ্যমে বিগত ১৮ নভেম্বর টেলিটকের ৩৩ হাজার ৫৩৪টি সিম অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশনে ব্যবহৃত হওয়ায় শনাক্ত করা হয় এবং গত ১১ অক্টোবর একই কারণে টেলিটকের ৪৪ হাজার ৫৬টি সিম বন্ধ করা হয়। সিম বিক্রির পর কোথায় তা ব্যবহৃত হচ্ছে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সেটি লক্ষ্য রাখার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির কমিশনার রেজাউল কাদের জানান, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগের দিন ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ থেকে পরবর্তী ৩ দিন হাইস্পিড মোবাইল ব্রডব্যান্ডের (থ্রিজি/ফোর জি) গতি কমিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওই সময় দেশে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল গড়ে প্রায় ১০০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ওই বৃদ্ধির কিছু অংশ গ্রাহকরা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কল করতে না পারায় হয়েছে; তবে অবৈধ ভিওআইপি না হওয়ায় সিংহভাগই বেড়েছে।
অবৈধ ভিওআইপিতে জড়িত থাকায় অপারেটরগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার জানান, ভিওআইপি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকা টেলিকম কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে জরিমানা বাবদ ৮৬০ কোটি ৬০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। তার মধ্যে গ্রামীণফোনকে সবচেয়ে বেশি জরিমানা করা হয়েছে। ওই অপারেটরটিকে জরিমানা করা হয়েছে ৪১৮ কোটি ৪০ লাখ, রবি আজিয়াটাকে ১৪৫ কোটি, বাংলালিংকে ১২৫ কোটি, র্যাংকস টেলিকমকে ১৫০ কোটি, পিপলস টেলিকমকে ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এফএন/এমআর