কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥
কলাপাড়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি হারানো আশ্রয়হারা হতদরিদ্র মানুষের পুনর্বাসনে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে নির্মিত হাজার হাজার ঘর এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। জীর্ণদশার কারণে এসব ঘরে আশ্রিত হাজারো পরিবার পুনর্বাসনের ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে আবার বেড়িাঁধের স্লোপে কিংবা এক চিলতে খাঁস জমিতে ঝুপড়ি তুলে চরম দুর্যোগঝুঁিকতে থাকছেন। ফলে ফের আশ্রয়হারা মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। আর পুনর্বাসনের এসব ঘর খালি পড়ে আছে। এমনকি এসব ঘরের টিন-চাল-বেড়া খুলে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। যথাযথ তদারকির অভাব এবং শ্রমজীবি মানুষের জন্য এসব ঘর বসবাস উপযোগী না হওয়ায় একদিকে ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয় নেয়ার উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। এদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সরকারের উদ্যোগে ৬৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্ষুদ্রঋণ সরকারি উদ্যোগে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২০১৩ সালে। মাত্র তিনটি আবাসন প্রকল্পের বাসিন্দাদের জন্য প্রায় ২২ লাখ টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে। বাকিরা বঞ্চিত রয়েছে। ফলে সরকারের এই যুগান্তকারী উদ্যোগ এখন ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অথচ এসব পরিবারের সদস্যরা কোন উপায় না পেয়ে বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়াসুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রকৃতির বুলডোজারখ্যাত ঘুর্ণিঝড় সিডর বিধ্বস্তে উপকূলীয় কলাপাড়ায় ১২ হাজার নয় শ’ পরিবার গৃহহারা হয়ে পড়েন। তখন এসব পরিবারকে আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের আবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ঠিকানাহারা এসব মানুষকে পুনর্বাসনে সরকারিভাবে আবাসন, বিশেষ আবাসন, জাপানি ব্যারাক হাউস, আশ্রায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ইউনিয়নে দেড় শতাধিক ব্যরাক হাউস করা হয়। যেখানে প্রায় দুই হাজার পরিবারের আশ্রয়স্থল করা হয়। এছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে পাঁচ হাজার পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়। ২০০৭ সালের সিডর পরবর্তী সময় থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পুনর্বাসনের কাজ চলে। কিন্তু তিন বছর না যেতেই এসব ঘরের এখন ব্যবহার উপযোগিতা নেই। টিনের চাল ঘুর্ণিঝড় মহাসেনে উড়ে গেছে। কোথাও আবার স্থানীয় লোকজন খুলে নিয়ে গেছে আবাসন ব্যারাকের বেড়া কিংবা চাল। প্রভাবশালীসহ যারা আবার ওইসব আবাসনে বসবাস করছে তারা একেকজনে একাধিক ব্যরাক দখল করে গবাদিপশু পালন করছেন। আবার দরিদ্র কর্মজীবি মানুষের কর্মস্থলের অনেক দুরে কিংবা বিরোধীয় খাস জমিতে এসব আবাসন প্রকল্প করা হয়েছে। মোট কথা কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার ছিন্নমূল শ্রমজীবি মানুষকে আশ্রয়স্থল করে দিলেও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ তদারকির অভাবে সকল উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত হয়ে পড়েছে। এসব মানুষকে একটু ঠিকানার জন্য সরকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন করেছিল। শুধু আশ্রয়স্থল নয়, আয় বর্ধনমূলক কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ হিসাবে গড়ে তুলে ক্ষুদ্রঋন দেয়ার প্রক্রিয়াও চালু করা হয়। কিন্তু সবই যেন ভেস্তে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব পুনর্বাসনের বেহালদশার ভয়াবহতার চিত্র। চাকামইয়া ইউনিয়নের গামুরি বুনিয়ায় ২০০৮ সালে এক শ’ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ১০টি টিনশেড ব্যারাক করে দেয়া হয়। মনোরম পরিবেশ। ইউ টাইপে তিনদিকে ব্যারাক হাউস। মাঝখানে একটি বিশাল পুকুর। দক্ষিণ দিকে একটি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। যেখানে আবাসনে বসবাসকারীদের শিশুরা লেখপড়া করার সুযোগ পাবে। পুকুরটিতে সমবায় সমিতির মাধ্যমে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার কথা। কিন্তু সব বেহালদশা। ১০ নম্বর ব্যরাকের ৭ নম্বর কক্ষের সালমা বাদল হাওলাদার দম্পতি জানালেন, পাঁচ বছর আগে তারা এখানে উঠেছেন। বর্তমানে থাকার উপায় নেই। চাল উড়ে গেছে মহাসেনে। একই ব্যরাকের চারটি কক্ষ বর্তমানে খালি পড়ে আছে। সাত নম্বর ব্যরাকের নয় নম্বর কক্ষে থাকছেন রাবেয়া আলফাজ দম্পতি। তাদের জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দ থাকলেও তারা থাকছেন তিনটি কক্ষ দখল করে। ৬ নম্বর ব্যারাকের আটটি কক্ষ খালি পড়ে আছে। বেড়ার টিন উধাও হয়ে গেছে এসব কক্ষের। এই ব্যারাকের তিনটি কক্ষে এখন গবাদি পশু রাখা হয়। পাঁচ নম্বর ব্যারাকের ১০টি কক্ষের চারটি খালি পড়ে আছে। এভাবে এখানকার ১০টি ব্যরাকের ১০০ কক্ষের অন্তত ৬০টি খালি পড়ে আছে। তিন নম্বর কক্ষের বাসিন্দা তারা বানু জানালেন, তাদেরকে সরকারি উদ্যোগে কোন সহায়তা দেয়া হয়নি।
একই অবস্থা চর ধুলাসারের দুইটি ব্যারাকের ২০টি কক্ষের মাত্র ১২টিতে লোকজন থাকছে। বাকিসব খালি রয়েছে। চরচাপলীর তিনটি ব্যারাকের ৩০টি কক্ষের ২১টি খালি পড়ে আছে। একটি ব্যারাকের চাল-বেড়া খুলে নেয়া হয়েছে। আইয়মপাড়া গ্রামের আবাসনের ব্যারাকটিতে বসবাসকারীদের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘর বুঝিয়ে দেয়া হয় নি। অথচ এরই মধ্যে ব্যারাকের টিন চাল জীর্ণদশায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। লোহার এ্যাঙ্গেলগুলো ভেঙ্গে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানি পড়ছে। টয়লেট ব্যবহার করা যায় না। মেলাপাড়া গ্রামের আবাসনটি করা হয়েছে সাত বছর আগে। অথচ অধিকাংশ ঘরের বেড়া কিংবা চালের টিন নষ্ট হয়ে গেছে। নদীরপাড়ে হওয়ায় জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প রয়েছে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নীলগঞ্জ গ্রামের নদীর পাড়ে। এখানে ২৮টি ব্যারাকে ২৮০টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। কলাপাড়া শহরের উল্টোদিকে হওয়ায় এখানে সবচেয়ে বেশি শ্রমজীবি মানুষ বাস করছে। এসব পরিবারের সদস্যদের সমবায়ের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে ক্ষুদ্রঋণ। কিন্তু কোনটাই সফলতায় পৌছেনি। ঘরগুলো জীর্ন হয়ে গেছে। যাদেরকে ঘর দেয়া হয়েছে তাদের অনেকে আবার অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছে। কয়েকটি ঘর মাদক ব্যবসায়ীরা দখল করে রমরমা মাদক ব্যবসা করে আসছে। এই ব্যারাকে চলছে অপরাধ মূলক কর্মকান্ড। সবচেয়ে বেশি বেহাল দশা চালিতা বুনিয়া আবাসনের। এখানে ১০টি ব্যারাকের এক শ’ কক্ষের মধ্যে মাত্র নয়টিতে লোক বসবাস করছে। বাকিসব খালি পড়ে আছে। খালি ঘরগুলো গোয়ালঘরে পরিণত হয়েছে। বেড়া টিন লাপাত্তা। চর ধুলাসার আবাসনের বাসিন্দা স্বামী পরিত্যাক্তা রাণী বেগম জানালেন, তাদের কোন ধরনের সহায়তা দেয়া হয় না। ব্যরাক হাউসটির আশপাশে তাদের কাউকে নামতে দেয়া হয় না। হাঁস-মুরগী পালন করতে পারেন না। গবাদিপশু পালনের সুযোগ নেই। সামনের সরকারি খালটি একটি মহল দখল করে রেখেছেন। সংযোগ সড়ক নেই। লেট্রিনগুলো ভেঙ্গে গেছে। একটি টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে গেছে। কর্মসংস্থানও নেই। দুইটি ব্যারাকের নয়টি ঘর খালি পড়ে আছে। একইদশা চাকামইয়া নিশান বাড়িয়া, খাজুরা, ফাঁসিপাড়া, পাখিমারা গুচ্ছ গ্রামের, আনিপাড়া, লেমুপাড়া, লোন্দা, ছোট বালিয়াতলী, তেগাছিয়া, ফতেহপুর আশ্রয়ন কিংবা আদর্শ গ্রামের। মোট কথা আবাসন, আশ্রয়ন কিংবা আদর্শ গ্রাম সবগুলোর এখন চরম বেহালদশা। বসবাস উপযোগিতা নেই। এসব প্রকল্প সরকারি অর্থায়নে করা হয়েছে।
এছাড়াও সিডর পরবর্তী সময়ে সৌদি সরকারের সহায়তা ১৫৪০টি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে ব্রিটিশ রেডক্রিস্টে ৭৫২টি, স্পিড ট্রাস্ট এক হাজার, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল ৬০০, সোস্যাল এসিসট্যান্স ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ৪৫টি, উরমাতা বাংলাদেশ ৯৪টি, ব্র্যাক ৩০টি, লায়ন্স ক্লাব ৩০টি, গ্রুপ থিয়েটার বাংলাদেশ ২০টি, অরকা রাজশাহী ৮০টি, ফ্রেন্ডশীপ ৪৯টি, কারিতাস ৬০০টি, স্পিড ট্রাস্ট (একশন এইড) ৮৪টি, প্রথম আলো একটি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়। কিন্তু এসব ঘর বসবাসের অনুপযোগি হয়ে গেছে। শতকরা ৯০টির কোন অস্তিত্ব নেই। আবার গৃহহারাদের তালিকায় অনিয়মের কারণে প্রভাবশালী লোকজন এসব ঘর বরাদ্দ নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছে। বহু ঘরের শুধু খুটি পড়ে আছে। আবার মহাসেনসহ অন্যসব দুর্যোগে এসব ঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। লালুয়ার চারিপাড়া গ্রামে দেখা গেছে এসব দৃশ্য।
সরকারি হিসাবে কলাপাড়ায় অন্তত ১৭০টি ব্যারাক হাউস করা হয়েছে। এছাড়া গুচ্ছ গ্রাম ও আদর্শ গ্রাম করা হয়েছে আরও দশটি। যেখানে কমপক্ষে দুই হাজার পরিবারের আবাসস্থল রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় দেড় হাজার পরিবার বসবাস করছে। কিন্তু কাগজপত্রে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে ৪৯৭ টি পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। এগুলো ছাড়াও রাখাইনদের জন্য তিনটি বিশেষ আবাসন করা হয়েছে। যেখানে ৫৭টি পরিবার বসবাস করছে। বর্তমানে এসব আবাসনের বাস্তব চিত্র কী তা খোদ সরকারি প্রশাসন সঠিকভাবে জানাতে পারেনি। তবে আশ্রিতদের অর্ধেক পরিবার বসবাস করতে পারছে না। এক কথায় চরম বেহালদশা আবাসন প্রকল্পের। যারা কোন উপায় না পেয়ে এখনও বসবাস করছেন তারা সকল সুবিধার বাইরে রয়েছেন। এসব হতদরিদ্র পরিবারের মাঁথা গোজার ঠাই মিললেও বর্তমানে তা আবার হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আশ্রিত পরিবারের সন্তানের জন্য লেখা পড়ার সহজ সুযোগ নেই। এছাড়া কর্মসংস্থান সহায়ক কোন কিছুই নেই। বাসিন্দাদের অভিযোগ আবাসন প্রকল্পের যথাযথ তদারকি এবং সরকারের দায়িত্ব প্রাপ্তদের পৃষ্ঠপোষকতা নেই। উপজেলা সমবায় অফিসের দেয়া তথ্যানুসারে তিনটি আবাসন প্রকল্পের দরিদ্র মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু রয়েছে। তাদের দাবি বাকিসব আশ্রয়নের বাসিন্দাদেরকে নির্মাণ করা ঘর ভূমি অফিস থেকে মালিকানার দলিলের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। তাই ওইসব মানুষকে ঋণ প্রোগ্রামের আওতায় আনা যাচ্ছে না। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক জানান, ওইসব আবাসন-আশ্রায়ন মেরামতের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে প্রত্যেক গৃহহীন-ভূমিহীনকে দুই শতক জমিসহ আলাদাভাবে সেমিপাকা ঘর দেয়া হচ্ছে। কোন গৃহহীন কিংবা ভূমিহীন বাদ পড়বে না।
এমইউএম/এমআর