নেছারাবাদ (পিরোজপুর) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
মেডিক্যালের ভর্তির সুযোগ পেয়েও পড়ালেখা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় নেছারাবাদের জলাবাড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ কামারকাঠি গ্রামের দিনমজুর বাবুল মোল্লার মেয়ে মোসা. শাবনুর। এ বছর মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় ৭৩.৫ নম্বর পেয়ে মেধা তালিকায় ৩৮৮৯তম স্থান পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে জামালপুরের শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন। সাবনুরের এই সফলতায় তার বাবা মা খুশি হলেও দারিদ্রতার কারনে মেয়ের ভবিষ্যৎ লেখাপড়া নিয়ে চরম দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন তারা। তাদের এখন একটাই চিন্তা কিভাবে মেয়ের মেডিকেলের পড়াশোনার খরচ চালাবেন।
সাবনুরের বাবা বাবুল মোল্লা এক সময় কাঁচামালের ব্যবসা করত। দীর্ঘ দিন যাবৎ তিনি হাঁপানি ও অ্যাজমা রোগে অসুস্থ হয়ে পড়লে এখন দিনমজুরের কাজ করেই সংসার চালাতে হচ্ছে। বাবুল মোল্লার চিকিৎসা ও সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে পরিবারটি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। সন্তানদের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ মেটাতে বাবুলের স্ত্রী সাবিনা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজও করেন।
সাবনুর ২০১৪ সালে জলাবাড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ কামারকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এ-প্লাস না পেলেও ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাস করেন। ২০১৯ সালে ওই ইউনিয়নের কামারকাঠি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে গোল্ডন এ-প্লাস পেয়ে এসএসসি পাস করেন। ২০২১ সালে স্বরূপকাঠি শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসিতেও এ-প্লাস পান। তিন ভাইবোনের মধ্যে সাবনুর সবার বড়। তার ছোট বোন সুমাইয়া দশম শ্রেনিতে ও ছোট ভাই সাব্বির সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
নিজের সফলতার গল্প বলতে গিয়ে সাবনুর বলেন, ছোট বেলা থেকেই আমার বাবাকে আমি অসুস্থ দেখছি। অসুস্থ থাকায় তিনি নিয়মিত কাজ করতে পারেননা। একটু সুস্থ হলে দিনমজুরের কাজ করে যে সামান্য টাকা আয় করেন সেটা দিয়ে তিনি নিজের জন্য চিকিৎসা না করিয়ে আমাদের জন্য ব্যয় করেন। আমাদের সংসারে পাঁচ জন সদস্য। পাঁচ জনের এই সংসার চালাতে বাবার পাশাপাশি আমার মা অন্যের বাসা বাড়িতে কাজ করে আমাদের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ চালাতে চেষ্টা করছেন। এক পর্যায়ে মা এনজিও থেকে অনেক ঋণ নিয়েছেন। সময়মত কিস্তি দিতে না পারায় বহুদিন এনজিও কর্মিদের কাছ থেকে গালমন্দ শুনে মনটা খারাপ হয়েছে কিন্তু লুকিয়ে কান্না করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা। অনেক দিনই না খেয়ে কলেজে যেতে হয়েছে। এখনো মাঝে মধ্যে অনাহারে থাকতে হয় আমাদের। আমার বাসা থেকে কলেজের দুরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। আমি প্রতিদিন পায়ে হেটেই কলেজে যাওয়া আসা করতাম। আমার কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. শাহ আলম স্যার ও মাহমুদুর রহমান স্যার আমাকে কলেজে বিনা বেতনে অধ্যায়নের সুযোগ সহ নানা ধরনের সহযোগীতা করেছেন। আমি স্বপ্ন দেখতাম আমি ডাক্তার হব, ডাক্তারি পোষাকে আমি রোগীদের সেবা করব। কিন্তু দারিদ্রতার কারনে কি আমার সেই স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। এখন আমি মেডিক্যালে ভর্তি ও পড়াশোনার খরচ কীভাবে চালাব তা নিয়ে চিন্তিত। আমি একজন মানবিক ডাক্তার হয়ে দেশ ও দেশের জনগনের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে চাই।
সাবনূরের মা সাবিনা বেগম বলেন, বাল্যবিবাহ ও দারিদ্রতার কারনে আমি লেখাপড়া করতে পারিনি কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি যেভাবেই হোক আমার সন্তানদের লেখাপড়া করাব। এজন্য ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ মেটাতে আমি ঘরে বসে পাটি ও হাতপাখা তৈরিসহ অন্যের বাড়িতে কাজ করছি। এনজিও থেকে ঋন গ্রহন করেছি। আমার মেয়ে মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে এ জন্য আমরা খুশি কিন্তু কিভাবে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাব সে চিন্তায় আর মুখে হাসি আসে না।
সাবনুরের বাবা বাবুল মোল্লা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, সাবনূরের জন্ম কেন আমার মত অভাবীর সংসারে হলো ওর মত রতœকে সঠিক স্থানে নিয়ে যাওয়ার সামর্থতো আমার নেই। সাবনুরের স্বপ্ন পূরনে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সমাজের বিত্তবানদের সহযোগীতা কামনা করেন।
শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, চেষ্টা ও মেধার কাছে দারিদ্র্যতা যে হার মানে সাবনুর সেটা করে দেখিয়েছে। কোন রকমের প্রতিবন্ধকতা সাবনূরকে দমাতে পারেনি। মেয়েটি যাতে মেডিক্যালে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারে সে জন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
নেছারাবাদের ইউএনও মো. মোশারেফ হোসেন বলেন, সাবনুর মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে এটা এই উপজেলার জন্য একটি গর্বের বিষয়। আর্থিক অভাবের কারনে সে ভর্তি হতে পারবেনা এমনটা হওয়ার সুযোগ নেই। এই মুহুর্তে সাবনুরের ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে যে খরচ রয়েছে সেটি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রহন করা হবে।
আরএ/এমআর