গলাচিপা (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
দিগন্তজোড়া সবুজের সমারোহ, লতায় মোড়ানো তরমুজ গাছ। এই গাছ দেখে শুরুতে চাষিদের মুখে হাসি ফুটেছিল। সময় গড়াতেই সেই হাসি ফিকে হয়ে যায়। ভেঙে গেছে কৃষকের বুকভরা স্বপ্ন। এ মৌসুমে অজানা এক রোগে তরমুজ চাষিদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এ রোগে পাতা কুঁকড়ে ফুল ঝরে গিয়ে গাছ মরে যায়, ফল ধরলেও তা ফেটে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজ উৎপাদনে অন্যতম এলাকা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার অনেক তরমুজ খেতেরই এমন অবস্থা। ফলে চাষিরা এখন দিশেহারা। এনজিওর ঋণ কিংবা আড়তদার দাদনের টাকা পরিশোধ নিয়ে পড়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়। কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, শতকরা ১০ শতাংশ খেত নষ্ট হয়ে প্রায় একশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
শনিবার সরেজমিন উপজেলার কাউখালী, হরিদ্রখালী, গহিনখালী, নেতা, আমলিবাড়িয়া, কাজির হাওলা ও চর ইমারশনসহ অন্তত ১০টি চর ঘুরে দেখা গেছে, অজানা রোগের সংক্রমণে কোনো খেতের গাছ মরে গেছে। কোনো খেতে ফলের আকার বাড়ছে না। আবার কোনো কোনো খেতে ফলের ওপর ফোটা ফোটা হলুদ দাগ পড়েছে। আরও দেখা গেছে, গাছ মরে যাওয়ায় কেউ কেউ খেত ফেলে চলে গেছে। এখন ওইসব খেতের মরা গাছগুলো গবাদিপশুর খাবার হয়েছে। তাই খেতজুড়ে বিচরণ করছে গবাদিপশুর পাল।
শুক্রবার বিকালে গহিনখালী গিয়ে কথা হয় তরমুজ চাষি আনোয়ার হোসেনের (৩৫) সঙ্গে। তিনি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড়কাছিয়া এলাকা থেকে এসে এখানে ৬ একর জমিতে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে তরমুজ আবাদ করেছেন। চার বছর ধরে তিনি এখানে এসে তরমুজ আবাদ করছেন। প্রত্যেকবার লাভের মুখ দেখলেও এবার তার মূলধনই শেষ। অজানা ওই রোগ তার খেতেও সংক্রমণ ছড়িয়েছে। গাছগুলোর পাতা কুঁকড়ে মরে গেছে। এখন গরু-মহিষে খাচ্ছে তার ক্ষেতের গাছ। তাই বাধ্য হয়ে খেতের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। খেত ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ছলছল চোখে তিনি বলেন, ধারদেনা করে লাভের আশায় তরমুজ দিই। কিন্তু ভাইরাসে (অজানা রোগ) এবার সব শেষ। এত শ্রম-কষ্ট সব বৃথা। কীভাবে মানুষের ধারদেনা দেব, আল্লাহ জানে।কথা হয় আরও এক তরমুজ চাষীর সঙ্গে, নাম বেল্লাল প্যাদা (৪৫)। প্রায় ১৫ বছর ধরে চরইমারশন গ্রামে তরমুজ আবাদ করছেন। এবারও ১০ একর জমিতে ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে তরমুজ আবাদ করেছিলেন। কিন্তু লাভ তো দূরের কথা, মাত্র ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পেরেছেন। বেল্লাল প্যাদা বলেন, বীজ রোপণের পর চারা গজিয়ে যখন ৪-৫ পাতা বের হয়, তখনই পাতাগুলো কুঁকড়ে গাছগুলো মরে যেতে শুরু হয়। খেত দূর থেকে দেখলে মনে হবে গাছগুলো পুড়ে গেছে। কোনো ওষুধে কাজ করে না। ফল টেকে না, ফেটে যায়। এবার আমাগো শেষ অবস্থা। ব্যবসাতো দূরের কথা, চালানও (মূলধন) পাই নাই।’শুধু আনোয়ার কিংবা বেল্লালই নয়, উপজেলার অধিকাংশ তরমুজ চাষির একই অবস্থা। তরমুজ চাষি আক্তার হোসেন, মেজবাহউদ্দিন, রফিক প্যাদা, মিথেল হাওলাদার, মফিদুল হাওলাদার, রায়হান মৃধাসহ বেশ কয়েকজন চাষি জানান, যারা তরমুজ দেন তাদের অনেকেই অন্যের জমি একসনা বন্দোবস্ত নিয়ে আবাদ করেন। জমিসহ প্রতি একরে খেত প্রস্তুত থেকে ফল কাটা পর্যন্ত ৭০-৮৫ হাজার টাকা খরচ হয়। বেশিরভাগ চাষি এনজিওর ঋণ, মহাজনের কাছ থেকে সুদ এবং আড়তদারের কাছ থেকে দাদন এনে তরমুজ আবাদ করে। কিন্তু চলতি মৌসুমে অজানা রোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা এবার সর্বস্বান্ত। কিভাবে পাওনা টাকা পরিশোধ করবে, তা নিয়ে এখন তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা যায়, তরমুজ লাভজনক ফল হওয়ায় প্রতিবছরই এর আবাদ বাড়ছে এ অঞ্চলে। চলতি মৌসুমে এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ৯ হাজার ৪৪৯ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। গত বছরের চেয়ে ১ হাজার ৮১৯ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ বেশি হয়েছে। কৃষি বিভাগের জরিপ অনুযায়ী, প্রতি হেক্টরে ৩৫ থেকে ৪০ টন উৎপাদন হারে প্রায় সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আবাদের ১০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় এক হাজার হেক্টর খেত নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে একশ কোটি টাকার লোকসান হবে চাষীদের, এমনটাই ভাষ্য কৃষি বিভাগের। কিন্তু কৃষকরা বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। তরমুজ খেত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর সম্প্রতি জেলার আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের একটি দল সরেজমিন তরমুজ খেত পরিদর্শন করেছেন। তারা এটিকে পাতা কোঁকড়ানো রোগ বলছেন। চাষীরা বলেন, এটি একটি ‘ভাইরাস’। জলবায়ু নিয়ে কাজ করা সংস্থা ভার্কের উপজেলা সমন্বয়কারী মোহসীন তালুকদার বলেন, তিন কারণে তরমুজ খেতে অজানা এ রোগ দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করছি। প্রথমত, দিন ও রাতে তাপমাত্রার ব্যাপক পার্থক্য। দ্বিতীয়ত, অধিকমাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ। তৃতীয়ত, একই জমিতে বারবার তরমুজ আবাদ করা। আগামীতে কৃষক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তরমুজ আবাদের শুরুতে দিনে ও রাতে তাপমাত্রার ব্যাপক পার্থক্যের কারণে গাছে পোকা-মাকড়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ কারণে কোনো পরামর্শ ছাড়া অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের কারণে পাতা কোঁকড়ানো রোগ আক্রমণ করতে পারে বলে ধারণা করছি। আক্রান্ত এলাকার কৃষকদের কীটনাশক ও মাকড়নাশক স্প্রে দিয়ে ব্যবহার করার পরামর্শ সংবলিত প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়েছে।এ ব্যাপারে আঞ্চলিক উদ্যানত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ইফতেকার মাহমুদ বলেন, রাঙ্গাবালী তরমুজ থেকে প্রথম যে বিষয়গুলো দেখেছি, তা হলো গাছের কাণ্ড ফেটে রস নির্গত হওয়া, কাণ্ড কালো হয়ে যাওয়া, গাছ ঢলে পড়া, পাতা কুঁকড়ে যাওয়া ইত্যাদি। আসলে এক জমিতে এক ফসল বারবার ফলালে রোগবালাই বেশি হয়। পোকা-মাকড়ের উপদ্রব দেখা দেয়।
এসডি/এমআর