বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত চিঠিই অনুপ্রেরণা শহীদ পরিবারের

প্রথম পাতা » পটুয়াখালী » বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত চিঠিই অনুপ্রেরণা শহীদ পরিবারের
শুক্রবার ● ১১ মার্চ ২০২২


বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত চিঠিই অনুপ্রেরণা শহীদ পরিবারের

মেজবাহউদ্দিন মাননু, সাগরকন্যা অফিস॥

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষরিত চিঠিটি বড় সম্বল। আর ওই চিঠির মাধ্যমে পাওয়া দুই হাজার টাকার চেকটি ছিল স্বামী হারানোর একমাত্র সান্তনা। এই চিঠিটি জীবদ্দশায় প্রতিনিয়ত পড়তেন স্ত্রী সীতালক্ষ্মী ভৌমিক। তিনিও ২০১৫ সালের ২৭ শ্রাবণ ইহলোক ছেড়েছেন। দেশের জন্য স্বামীর আত্মত্যাগের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি শহীদ পরিবার হিসেবে জোটেনি। ২০০৪ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা এবং বিজয় দিবসে উপজেলা সদরে আমন্ত্রণ জানানো হতো। শহীদ পরিবার হিসেবে সম্মান দেখানো হতো। কিছু একটা উপটৌকন ধরিয়ে দেয়া হতো। এখন আর তাও জোটে না।
মহান মুক্তিযুদ্ধে কলাপাড়ার প্রথম তালিকায় তিনজন শহীদের নামের মধ্যে দ্বিতীয় নামটি তার। শহীদ প্রফুল্ল মনভৌমিক। মোট তিন জনের নাম ছিল। আর দু’জন বিনোদ বিহারী দত্ত, সুরেন্দ্র মোহন চৌধুরী। পরবর্তীতে এ তালিকা দীর্ঘ হয়ে গেছে। দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার অপরাধে ১৯৭১ সালের ১৬ মে দিবাগত ভোর রাতে (আনুমানিক চার টায়) পাখিমারার বাড়ি থেকে পাকিস্তানি হায়েনারা ধরে নেয় দানবীর প্রফুল্ল মনভৌমিককে। স্থানীয় রাজাকার এক ভাইস চেয়ারম্যান বাড়িটিসহ তাকে চিনিয়ে দেয়। সাথে ছিল ওই ইউনিয়নের আরেক রাজাকার। পরেরদিন, ১৭ মে। সকালে কলাপাড়া শহরের খেপুপাড়া হাই স্কুল মাঠের নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হয় তাকে। এরপরে আন্ধারমানিক নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে মৃতদেহ ভেসে থাকার খবর পেয়েছেন। কিন্তু জীবনের ভয়ে লাশ শণাক্ত করতে যায়নি সজনেরা। এসব কথা বলতে গিয়ে দু’চোখ ছল ছল করছিল শহীদ প্রফুল্লের বড় সন্তান প্রদীপ ভৌমিকের। বাবা নিজের জীবন দিয়ে দেশের প্রদীপ জ¦ালিয়ে গেছেন। কিন্তু ছেলে প্রদীপ আর নিজেকে জ¦ালাতে পারেননি। প্রদীপে এখন আর সংসারে আলো দিতে পারে না। নেই উজ্জল রঙ। ধুসর। বিবর্ণ সব।
প্রদীপ জানান, তখন তার বয়স ১০ কি ১১ বছর। সব মনে আছে। জীবদ্দশায় দেশের জন্য জীবন ত্যাগী তার বাবা নিজের অজ¯্র সম্পত্তি, জমিজমা দান করেছেন। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তেই করেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আজকের প্রফুল্ল ভৌমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় ৬৬ শতক জমি দেন। নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের জন্য এক একর। স্বাস্থ্য ক্লিনিকের জন্য ১০ শতক। সমাজকল্যানের একটি স্থাপনার জন্য ১০শতক জমি দিয়ে গেছেন। সবশেষ দ্বীপ্ত যৌবন উৎসর্গ করলেন।
জমিজমা এরপরও যা ছিল তাও পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তাদের তিন একর জমি গেছে সেখানে। মাত্র ৩১ শ’ টাকায় কড়া (তিন শতক)। তাও বিভিন্ন অফিস খরচ বাবদ দুই ভাই হাতে পেয়েছেন এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা। কেউ যেন একটু দয়া দেখায়নি শহীদ এ পরিবারের প্রতি। যার বাবার সব ছিল ত্যাগ। করেছেন উৎসর্গ। তার সন্তানদের কাছ থেকে উল্টো কালো হাতের থাবায় চলে গেছে অধিগ্রহণের অনেক টাকা। এ পরিবারটি ‘৯৬ সালের পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করে অনুদান পেয়েছিলেন দশ হাজার টাকা। এখন নিজের জমিতে করা পাট গবেষণায় দয়ার দান হিসেবে একজন শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন প্রদীপ। তাও এখন শরীরের সায় দেয় না। অসুস্থতায়। ছোট ভাই অসিত ভৌমিক বেকার। দুই ভাইয়ের আট জনের সংসার। চলে তো, আবার চলে না। তবুও দিন তো থেমে থাকে না।
প্রদীপ অশ্রুছল চোখে আর জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বললেন, ‘ শুনেছি বাবায় পানি খাইতে চাইছে মরার আগে, দেয় নাই।’ বলেই নীরব। নিথর। আবার সম্বিৎ ফিরে, ডাক দেয়ায়। কতবার শহীদ পরিবার হিসেবে ভাতা কিংবা আর্থিক সহায়তার জন্য ইদুর দৌড় দৌড়েছেন। কিন্তু কারও মন গলেনি।  প্রদীপ দেখালেন, তার মাকে উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত চিঠিতে লেখা রয়েছে,‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন।’ ১৯৭২ সালের ৬ অক্টোবরের লেখা বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত এই চিঠিটি প্রদীপ ভৌমিক লেমিনেটিং করে রেখেছেন। সঙ্গে শহীদ পরিবারের নাম বাছাই করা কয়েকটি তালিকা। এছাড়াও ২০১২ সালের ২০ মার্চ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, গণভবন কমপ্লেক্স শেরে বাংলা নগর ঢাকার লাইব্রেরিয়ান মোঃ মনিবুর রহমান এক চিঠিতে কলাপাড়া উপজেলায় স্মরনীয় যারা একটি বইয়ে প্রফুল্ল মন ভৌমিককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিহীত করেছেন। তার নাম স্মরনীয় হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। তিনি এ সংক্রান্ত একটি চিঠিও শহীদ প্রফুল্ল ভৌমিকের ভাই প্রশান্ত ভৌমিককে দিয়েছেন।
প্রদীপও এখন বার্ধক্যের ছাপে পড়েছেন। শুধু নীরবে তার বাবার গৌরবগাঁথা কীর্তির স্মৃতিচারন করেন আর হিসেব মেলায় তার বাবা ভুল করেছেন, না ঠিক করেছিলেন। কিন্তু কোন হিসেব মেলাতে পারেন না। যখন দেখতে পায় ওই রাজাকার এখনও বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় তাদের বাড়ির সামনের মহাসড়ক দিয়ে। যখন দেখেন বাড়ির চাল-ডাল কেনার জন্য পাট গবেষণায় শ্রমিকের কাজ করতে হয়। যখন ভাবেন কম্পিউটার বিষয়ে চার বছরের ডিপ্লোমা নেয়া ছেলের জোটেনি সরকারি কোন চাকরি।এমনকি নিজের বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতেও নয়। মেয়ে অনার্স পড়ছেন। এ শহীদ পরিবারটি সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের তালিকায় আবেদন করে সাক্ষাৎকারে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু কোন ফলাফল জোটেনি। আক্ষেপ, কত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে তালিকায়। নিচ্ছে ভাতা। বাদ যায়নি রাজাকারের সন্তানেরাও। শুধু আফসোস। বাবার স্বীকৃতি মা দেখে যেতে পারেন নি। তিনিও পারবেন কী দেখতে? এমন অনিশ্চয়তার দোলাচালে সিগারেটের ধোয়ায় আচ্ছন্ন করে মুখের কৃত্রিম হাঁসিতে চেয়ে থাকেন আমাদের দিকে। এ চাহনি যেন শত প্রশ্নের উত্তর খোঁজে বেড়ায়। আমরাও বিমর্ষ মনে বিদায় নিলাম। মনে মনে অনেক প্রশ্নের জট লেগে গেল নিজের মনেই–।

এমইউএম/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২২:২৭:৩২ ● ৩৮৮ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ