মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার জনজীবনের জন্য হুমকিতে

প্রথম পাতা » জাতীয় » মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার জনজীবনের জন্য হুমকিতে
সোমবার ● ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৯


মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার জনজীবনের জন্য হুমকিতে

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

জনজীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে বাসাবাড়ি ও যানবাহনে ব্যবহৃত অনিরাপদ ও মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার। বিভিন্ন যানবাহনে যে গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে তার ৭০ ভাগ রি-টেস্টিংয়ের আওতার বাইরে থাকছে। ফলে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করায় একেকটি গাড়ি একেকটি বোমা বহন করে চলেছে। অতিসম্প্রতি পুরান ঢাকার চকবাজারে যে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা মূলত সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকেই ঘটেছে। চকবাজারের ঘটনায় ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া গেলবছরের ১৭ জুলাই টাঙ্গাইলের একটি মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় একই পরিবারের ৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সড়কে স্পিড বেকারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে ওই মাইক্রোবাসটির গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে। এক হিসাবে দেখা গেছে, বিগত ৫ বছরের ৩শ’র বেশি সিলিন্ডার দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাতে মানুষ মারা গেছে ২শ’রও বেশি। গ্যাস সিলিন্ডার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বিশেষজ্ঞদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতি ৫ বছর পর পর যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের মান পরীক্ষা করা বা রি-টেস্টিং করা বাধ্যতামূলক। রি-টেস্টিংয়ের মান ভাল পাওয়া গেলে সেটি আরো ৩ বছর অতিরিক্ত ব্যবহারের বিধান রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ১০ থেকে ১৫ বছর ব্যবহারের পরও সিলিন্ডর রি-টেস্টিং করা হচ্ছে না। ওই অনিরাপদ সিলিন্ডার থেকে প্রতিনিয়তই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে এবং চলে যাচ্ছে বহু প্রাণ। ভাঙ্গাচোরা সড়ক-মহাসড়ক ও স্পিড বেকার কারণেও যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়ছে। সড়ক ও স্পিড বেকারের ধাক্কা লেগে প্রায়ই যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ফলে মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধরে হতাহতের ঘটনা ঘটে। বর্তমানে গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনা মহাসড়কে একটি মারাত্মক মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানায়, বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত সিলিন্ডারও ঝুঁকিমুক্ত নয়। বর্তমানে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ কমে আসার ফলে সিলিন্ডারে বাজারজাত এলপি গ্যাসের চুলায় রান্নাবান্নার প্রচলন বাড়ছে। শহরাঞ্চলের অনেক বাসাবাড়ি, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে গ্যাসসংযোগ না পাওয়ায় রান্নার কাজে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলেরও আয় বৃদ্ধির ফলে অনেক পরিবার এখন মাটির চুলার পরিবর্তে গ্যাসের চুলায় রান্না করছে। আর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে সিলিন্ডারের গ্যাস। এমন পরিস্থিতিতে ঝুঁকি এড়াতে বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের বিষয়ে ব্যাপক জনসচেনতা প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিন্তু ওই ব্যাপারে দেশের মানুষের মধ্যে তার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ফলে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অহরহ মানুষ মারা যাওয়ার পাশাপাশি গুরুতরভাবে জখম হয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারানোর ঘটনাও ঘটছে। সিভিল ডিফেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের হিসাব অনুযায়ী বিগত বছর পর্যন্ত এ ধরনের গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৭৮টি। আগের বছর ছিল ৭৯। ২০১৬ সালে ১৩১ এবং ২০১৫ সালে ৮০টি গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজের অগ্নিকা-ের দুর্ঘটনার সূত্রপাত এমনই এক সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে ঘটেছে। পরে কেমিক্যাল বিস্ফোরণে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আর রাস্তায় ও আশাপাশের বিভিন্ন ভবনে থাকা বিপুলসংখ্যক মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয় প্রাণ হারিয়েছে। আর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে দুর্ঘটনা এবারই প্রথম নয়। দেশে অনেক আগে থেকেই এমন ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তাতের মানুষের ব্যাপক প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে প্রচুর।
সূত্র আরো জানায়, বিশেষজ্ঞরে মতে মূলত দুটি কারণে যানবাহন ও বাসাবাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডারের দুর্ঘটনা ঘটছে। যানবাহনে যেসব সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয় তা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না। এমনকি দেশের বেশিরভাগ সিলিন্ডার মেয়াদ উত্তীর্ণ। ওই কারণেই সড়ক-মহাসড়কে চলাচলরত একেকটি গাড়ি একেটি জলন্ত বোমা হয়ে দেখা দিচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে গ্যাস সিনিন্ডারের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। সেজন্য সড়ক ও পরিবহনসহ অন্যান্য সংস্থার অবহেলা ও উদাসিনতা এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। কারণ সড়কের স্পিড বেকারের ধাক্কা খেয়ে যানবাহনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা ঘটছে। অতিসাম্প্রতিক সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে পুরান ঢাকার চকবাজারের অগ্নিকান্ডে বিপুল প্রাণহানির সূত্রপাত। আর ওই ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে বাসাবাড়ি, যানবাহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত গ্যাসের সিলিন্ডার আসলে কতটা নিরাপদ। কারণ হরহামেশায় ব্যবহার হচ্ছে মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডার।
এদিকে শুধু সিলিন্ডার বিস্ফোরণ নয়, গ্যাস পাইপলাইনের ত্রুটি থেকে বিস্ফোরণ ঘটেও দুর্ঘটনা ঘটছে এবং অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছে। ঢাকার বিভিন্ন বস্তি এলাকায় এবং তার আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে অনেক গ্যাসপাইপ সংযোগ নেয়া হয়েছে। অনেক গ্যাস পাইপলাইনে কারিগরি ত্রুটি রয়েছে। ফলে মাঝে মধ্যে পাইপলাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ঘটে মানুষের হতাহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিগত ডিসেম্বরের নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পাইপলাইনের লিকেজ বিস্ফোরণে দগ্ধ হয় একই পরিবারের নয়জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইপলাইনের বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে বিস্ফোরণ, চুলার ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণসহ নানাভাবে দুর্ঘটনা ঘটে মারা যাচ্ছে মানুষ। নষ্ট হচ্ছে সম্পদ। অনিরাপদ ও মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারের ঝুঁকি প্রসঙ্গে নাভানা সিএনজির সিনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ কামরুজ্জামান জানান, বিভিন্ন যানবাহনে নাভানার সরবরাহ করা ১ লাখেও বেশি সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যে ৭০ ভাগই রি-টেস্টিং করাতে আসে না। তবে চকবাজারের ঘটনায় বিগত দু’দিনে ওই রি-টেস্টিংয়ের পরিমাণও বেড়ে গেছে। যদিও প্রতি ৫ বছর পর পর সিলিন্ডার মান পরীক্ষার নিয়ম রয়েছে। পরীক্ষায় মান ভাল হলো সেটা আরো তিন বছর করা যেতে পারে। তার পরেই নতুন সিলিন্ডার ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। কিন্তু ১০ থেকে ১৫ বছর পেরিয়ে গেলে কেউ সিলিন্ডার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে না। বিগত ২০০১ সাল থেকে গাড়িতে সিলিন্ডারে করে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। তাতে টু স্ট্রোক ইঞ্জিন থেকে ছড়ানো দূষণ অনেকটাই কমে আসে। পাশাপাশি সাশ্রয়ী জ্বালানিতে চলাচলের সুবিধা থাকায় প্রাইভেট কারের সংখ্যাও বাড়ে। তবে সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা নিয়ে গাড়ি মালিকদের অনীহার কারণে বিষয়টি এখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি গ্যাস সংকটেও এটি ভূমিকা রাখছে। গাড়িতে ব্যবহৃত মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত অপসারণে বিআরটিএকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান জানান, অনিরাপদ ও মেয়াদোত্তীণ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারকারী গাড়িগুলো সড়ক-মহাসড়ক একেকটি জীবন্ত বোমা নিয়ে চলাচল করছে।
অতিসাম্প্রতিক চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গাড়িতে সিলিন্ডারে করে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের চিন্তা করছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একথা জানান। মন্ত্রী বলেন, সিলিন্ডারের ব্যাপারে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিআরটিএকে নিয়ে একটা সমাধানে পৌঁছার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সিলিন্ডার যেহেতু এতো বিপজ্জনক অবস্থানে পৌঁছেছে, সুতরাং এ সিলিন্ডার ব্যবহার না করাই ভালো। কাজেই সিলিন্ডার বন্ধ করার ব্যাপারে সচিবকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অচিরেই এর একটা ব্যবস্থা হবে।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ১৮:১৬:৪০ ● ৬১৮ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ