বসত ঘর তোলার হিড়িক, দূর্যোগকালীন ঝুঁকি বাড়ছে মানুষ ও সম্পদের

প্রথম পাতা » লিড নিউজ » বসত ঘর তোলার হিড়িক, দূর্যোগকালীন ঝুঁকি বাড়ছে মানুষ ও সম্পদের
রবিবার ● ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৯


---

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে॥
উপকূলীয় সাগরপাড়ের জনপদ কলাপাড়ায় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল দখল করে এখন বসতবাড়ি তোলার হিড়িক চলছে। ফলে দূর্যোগকালীন সময় ঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে মানুষ ও তাঁদের সম্পদ রক্ষাকবচ সবুজ দেয়াল বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আশঙ্কাজনকহারে কমে যাচ্ছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল। প্রায় চার শ’ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বাইরের অন্তত দুই শ’ কিলোমিটার এলাকার ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। এমনকি সংরক্ষিত বনাঞ্চল পর্যন্ত উজাড় হয়ে গেছে। এসব বনে এখন আর বন্যপ্রাণী থাকে না। বসতভিটা করছে মানুষ। দখল ও বসতঘর তোলার কারণে এখন হুমকির মুখে পড়েছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল। এই প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে।
কলাপাড়ার গোটা জনপদে একসময়, (ষাটের দশকে) ছিল ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চলে ঘেরা। বেড়িবাঁধ করার পরে জোয়ার-ভাঁটায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এ প্রজাতির ছইলা, কেওড়া, গোলগাছ, গেওয়াসহ গুল্ম জাতীয় গাছপালা বেড়িবাঁধের বাইরে জন্মায়। বাঁধের অভ্যন্তরে (ভেতরের) গাছগুলো মরে যায়। বন-জঙ্গলে পরিপুর্ণ ছিল এ উপকূল। অনেক প্রজাতির গাছের চারা বনবিভাগ রোপন করেছে। বেশিরভাগই ছিল প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো। এসব সবুজ বনাঞ্চল দুর্যোগকালীন মানব বসতিদের ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা থেকে রক্ষার কবচ হয়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে সবুজ দেয়ালের মতো জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা প্রতিরোধ করত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দখল ও বসতঘর তোলার তান্ডব। মধুখালীর লেকটি প্রায় ১২ কিমি দীর্ঘ ছিল। প্রায় ছয় কিমি এলাকায় এখনও প্রাচীণকালের ছইলা কেওড়া গাছে পরিপুর্ণ লেকটির দুই পাড়। কিন্তু প্রাচীন গাছগুলো কেটে সাবাড় করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ বাগানোর মধ্যে শতাধিক বসতঘর তোলা হয়েছে। কলাপাড়া ভূমি অফিস এই বনাঞ্চলকে চাষযোগ্য কৃষিজমি দেখিয়ে বহু আগে বন্দোবস্ত দেয়। এ দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। সবশেষ লেকটির পূর্বপাড়ের শতাধিক গাছ গেল বছর কেটে মাছের ঘের ও বসতঘরের ভিটি করা হয়। এনিয়ে তোলপাড় হয়। কিন্তু বনবিভাগ ৫০ বছর লেকের দুই পাড়ের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল পাহারা দিলেও এখন তাঁরা বলছেন এ বাগানটি ভূমি অফিসের। বর্তমানে মধুখালী লেকের দুই দিকের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল হুমকির মুখে পড়েছে। যে যেভাবে পারছে দখল করছে। কাটছে গাছ। স্থানীয় মহিউদ্দিন হাওলাদার জানান, ১০/১৫ বছর আগে এই দীর্ঘ এলাকাজুড়ে গভীর বনাঞ্চল ছিল। ছইলা, কেওড়া, গোল, গেওয়া গাছে ছিল পরিপূর্ণ। বেড়িবাঁধ দিয়ে একা হাটতে ভয় লাগত। বনে ছিল শেয়ালসহ বন্যপ্রাণী। বন্যার সময় জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা বাধা পেত ওই বাগানে। বুক আগলে কোলের সন্তানের মতো মানুষ ও তাঁদের সম্পদ রক্ষা করত ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছপালা। এবাগান ধ্বংস হওয়ায় এখন বন্যার পানিতে বেড়িবাঁধও হুমকির কবলে পড়েছে। লতাচাপলী ও ধুলাসার ইউনিয়নের একাংশ নিয়ে গঠিত পোল্ডার নম্বর ৪৮। দীর্ঘ এ পোল্ডারের বাইরে ছিল অন্তত ৫০ কিলোমিটার এলাকায় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চলে ঘেরা। মানুষ দিনের বেলা একা চলতনা বন্যপ্রাণীর ভয়ে। এখন বিরানভূমি। মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। ইটভাটা, মাছের ঘেরে সয়লাব। কলাপাড়া পৌর শহর ও টিয়াখালী ইউনিয়ন জুড়ে বাঁধের বাইরের অধিকাংশ ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বাগান কেটে উজাড় করা হয়েছে। এখন শত শত বাড়িঘর তোলা হয়েছে। এখন বন্যপ্রাণী দুরের কথা উল্টো সেখানে মানুষের কোলাহলে পরিণত হয়েছে। ১২টি ইউনিয়নের একই দৃশ্য। এমনকি সংরক্ষিত বনাঞ্চল পর্যন্ত উজাড় করা হয়েছে। এসব যেন দেখার কেউ নেই। প্রত্যেকটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানগণ জানান, এসব বনাঞ্চল রক্ষার দায়িত্ব প্রথমত বনবিভাগের। তাঁরা উদাসীন রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড অধিগ্রহণ করা জমিতে বাঁধ করেছে। বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্লোপের নিচের যে জমি রয়েছে ওই জমিতে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল গড়ে ওঠে। কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ প্রজাতির মাইলের পর মাইল বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। এখন তা বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, নদীপাড়ে এবং বেড়িবাঁধের বাইরে এখনও প্রাকৃতিকভাবে জন্মাচ্ছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছপালা। যা শুধু রক্ষা করা প্রয়োজন। তাইলেই ফের উপকূলীয় সবুজ দেয়াল গড়ে তোলা সম্ভব। নইলে ঝড় জলোচ্ছ্বাসের গ্রাসে থাকা এই জনপদ ও জনপদের মানুষের দুর্যোগকালীণ ঝুঁকি আরও বাড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬:২৬:৫৩ ● ৫৫৪ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ