ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
উৎপাদন খরচ কমাতে তেলভিত্তিক কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ফলে দেশে নতুন করে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হবে না। পাশাপাশি সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে পরিচিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদনের ক্ষেত্রেও কিছু শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ৪০০ মেগাওয়াটের কম সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হবে না। তবে দেশে এখনো বেশকিছু তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন ও দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত এক দশকে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় সাড়ে ৩ গুণ বেড়েছে। আর গত আমদানিসহ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৬৮৯ মেগাওয়াটে (ক্যাপটিভ বাদে)। ওই সময়ে ১শটির বেশি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র যোগ হয়েছে। কিন্তু ওসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বেশির ভাগই ব্যয়বহুল জ্বালানি ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক। তার মধ্যে ৬৭টি ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকাংশই আবার ভাড়াভিত্তিক। ফলে ওসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে ৭-৮ গুণ বেশি। ক্যাপাসিটি চার্জ, জ্বালানি ব্যয়সহ ওসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ হিমশিম খাচ্ছে। ওই ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা যত বাড়ছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) লোকসানও ততো বড় হচ্ছে। বিগত এক দশকে যেসব বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, চলতি বছর থেকে সেগুলো উৎপাদনে আসা শুরু করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। আর বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে নতুন করে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন হবে না।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ৩ বছর, ৫ বছর ও ১৫ বছর মেয়াদি তেলভিত্তিক যেসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে, চুক্তির মেয়াদ শেষে ওসব কেন্দ্রে সঙ্গে নতুন করে চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অবশ্য বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বর্তমানে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ভিত্তিতে বিদ্যুৎ নেয়া হয়ছে, চুক্তি শেষ হতে হতে সেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে থাকবে না। ফলে মেয়াদ ফুরালে সঙ্গত কারণেই ওসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে নতুন করে চুক্তির সুযোগ থাকবে না। তবে নতুন করে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার পরিকল্পনা নেয়া হলেও বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি খাতে যে ১৩ হাজার ৩২ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে, তার মধ্যে ২৬টিই ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক। ওসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদনক্ষমতা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯৪ মেগাওয়াট। ৯১১ মেগাওয়াট ছাড়া যার পুরোটাই ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের। বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ৩ টাকা ৭ পয়সা। কিন্তু ফার্নেস অয়েলভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ৯ থেকে ১১ টাকা। আর ডিজেলভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হয় ২০ থেকে ২৭ টাকা।
সূত্র আরো জানায়, বিদ্যুৎ বিভাগ দেশে কয়লাভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও বেশকিছু বিষয় বিবেচনা করছে। তার মধ্যে ৪০০ মেগাওয়াটের কম ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন কোনো কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন না দেয়া হবে না। সরকারি কিংবা বেসরকারি যে কোনো খাতে নতুন করে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা ৪০০ মেগাওয়াটের অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। যদিও বর্তমানে কয়লাভিত্তিক যে ২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে তার মধ্যে ২০০-৩০০ মেগাওয়াটের মধ্যে ৩টির উৎপাদনক্ষমতার রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে মেঘনাঘাটে চর বলাকিয়ায় ওরিয়ন পাওয়ার লিমিটেডের ২৮২ মেগাওয়াট ও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ২৮২ মেগাওয়াট এবং আইসোটেকের পটুয়াখালীর বরগুনায় ৩০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লাভিত্তিক ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি বেশি থাকে। কারণ ওসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাব-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। যদিও সুপার-ক্রিটিক্যাল ও আল্ট্রাসুপার-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারের নজিরও রয়েছে।
এদিকে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ক্রমেই বড় ধরনের অসমতা তৈরি হচ্ছে। পিক সিজন তথা বেশি চাহিদার সময় এখন পর্যন্ত দেশের মোট বিদ্যুতের চাহিদা ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। অন্যদিকে অফ পিক সিজনে তথা শীতকালে সর্বোচ্চ চাহিদা ৭ থেকে সাড়ে ৭ হাজার মেগাওয়াট। শীতকালে প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াটের পাশাপাশি গ্রীষ্মকালেও ৫-৬ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হয়। কিন্তুবসিয়ে রাখলেও বিপিডিবিকে ক্রয়চুক্তি অনুযায়ী ওসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক (ডিজি) প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন জানান, নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ শেষে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবির কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি বিশেষ কোনো প্রয়োজন ও পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে নতুন করে চুক্তি হতেও পারে।
একই বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ জানান, ব্যয়বহুল সত্ত্বেও জরুরি চাহিদা মেটাতে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নিতে হয়েছে। তবে যেহেতু কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এ বছর থেকে উৎপাদনে আসা শুরু করছে, তাই নতুন করে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার পক্ষে বিদ্যুৎ বিভাগ।
এফএন/এমআর