ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
সরকার পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরাতে উদ্যোগী হলেও মালিকরা তা না মানার বিষয়টি ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাকাণ্ডের ঘটনায় রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হবে।
তিন দিন আগের ওই অগ্নিকাকাণ্ডে দগ্ধদের দেখতে শনিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যান প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। নিহতদের পরিবারের প্রতি আমি সহমর্মিতা জানাই। এজন্য জাতীয় শোক পালন করা হবে।
বুধবার রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ে ভয়াবহ ওই অগ্নিকাকাণ্ডে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়। আহতদের মধ্যে নয়জনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে, তাদের অবস্থাও ভালো নয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, একটি পিকআপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর চুড়িহাট্টা মোড়ে ওই অগ্নিকাকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। পরে তা আশপাশের পাঁচটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ওই মোড়ের আশপাশের দোকান আর ভবনে থাকা রাসায়নিক এবং প্লাস্টিক ও প্রসাধনীর গুদাম চুড়িহাট্টার আগুনকে ভয়াবহ মাত্রা দেয় বলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ধারণা।
নিমতলীতে ২০০৯ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাকাণ্ডে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর তদন্ত কমিটি পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। নয় বছরেও সেই সুপারিশের বাস্তবায়ন না হওয়ায় চুড়িহাট্টার মত ঘটনা আবার ঘটল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন আগুন লাগল তার আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল কারখানা, গোডাউন সরানো হবে। কেউ তখন রাজি হয়নি। আমরা আধুনিক গোডাউন করে দিতে চাইলেও মালিকরা রাজি হননি। দুর্ভাগ্য এটা আমাদের। চকবাজারে কেন আগুন লেগেছে তা তদন্ত করে দেখার পাশাপাশি সব স্থাপনায় অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার ওপর জোর দেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুরান ঢাকার সরু রাস্তা, গলি নতুন করে করতে হবে। রাস্তাগুলো এত সরু যে সেখানে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার কোনও উপায় নেই।
তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় এত গলি যে, আমরা হেলিকপ্টার দিয়েও পানি দিতে পারিনি। এটাও খেয়াল রাখতে হয়েছে যে হেলিকপ্টারের বাতাস থেকেও আগুন ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই নিরাপদ দূরত্ব থেকে হেলিকপ্টারে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আগুন ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কেমিকেল গুদামগুলো দায়ী উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মোবাইল কোর্ট বসিয়ে অনেক কারখানা অপসারণ করেছি। কিন্তু সেগুলো গড়ে উঠেছে। এগুলো দ্রুত সরিয়ে নিতে হবে। ২০০৯ সালে নিমতলীর অগ্নিকাকাণ্ডের পর আমরা পুরান ঢাকার কেমিকেল গুদাম সরাতে চেয়েছিলাম। তার জন্য কেরানীগঞ্জে জায়গা করে প্রজেক্ট নিয়েছিলাম। আধুনিক গুদাম তৈরি করে দিতে চেয়েছিলাম। এসব কেমিকেলের সুরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। কিন্তু মালিকরা রাজি হয়নি, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। সাংবাদিকদের কারণে আগুন নেভানোর কাজ ব্যাহত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবাদ কর্মীদের নানা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আগুন নেভানো ব্যাহত হয়েছে। বিশেষ করে টিভি সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন। এটা কী প্রশ্ন করার সময়? উত্তর আশা করেন কীভাবে? তারা কাজে যাবেন। অথচ তাদের আটকে রেখে প্রশ্ন করা হচ্ছে। এছাড়াও আগুন ও তাতে দগ্ধদের ছবি তোলার বিষয়ে সংবাদকর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। যাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে না পড়ে। আগুন নেভানোর জন্য পানির উৎসের অপ্রতুলতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকায় একসময় অনেক পুকুর ছিল সেগুলো ভরাট করে ফেলা হয়েছে। একসময় পুরান ঢাকার ধোলাই খাল ও আশপাশে অনেক খাল ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেগুলো দখল হয়ে গেছে, স্থানীয়রা ভরাট করে ফেলার কারণে ওই এলাকায় দুর্ঘটনার সময় পানি পাওয়া যায় না। নেভানোর সময় যদি পানি না পাওয়া যায়, তাহলে ফায়ার সার্ভিসের কী করার আছে? রোববার অফিস খুললে মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টার আগুনে হতাহতদের জন্য রাষ্ট্রীয় শোকের ঘোষণা আসবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, এটা একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা যা আমাদের সবাইকে ব্যথিত করেছে। আহতদের চিকিৎসার খোঁজ খবর নেওয়ার পাশাপাশি তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে প্রধানমন্ত্রী সান্ত¡না দেন, সেই সঙ্গে দেন পাশে থাকার আশ্বাস। বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আগুনে আহতদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন। দগ্ধ প্রত্যেক পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছেন প্রাথমিকভাবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন বলেন, প্রধানমন্ত্রী বার্ন ইউনিটে আহতদের দেখার পর তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের পাশে থাকবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন, সান্তনা দিয়েছেন। বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল জানান, চকবাজারের ঘটনায় দগ্ধ নয়জন এখন হাসপাতালে আছেন, সবাই আইসিইউতে। তাদের পাঁচ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। চার জনের অবস্থা মোটামোটি। তাদের সুস্থ করতে আমরা সব ধরনের চেষ্টা করব। এটা প্রধানমন্ত্রীরও নির্দেশ।
অন্যদের মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন, উপমন্ত্রী এনামুল হক শামিমসহ ঢাকা মেডিকেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
এফএন/এমআর