চকবাজারে অগ্নিকাণ্ড: সেই ভবনে এখনো প্রচুর রাসায়নিক পদার্থের মজুদ

প্রথম পাতা » সর্বশেষ » চকবাজারে অগ্নিকাণ্ড: সেই ভবনে এখনো প্রচুর রাসায়নিক পদার্থের মজুদ
শুক্রবার ● ২২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯


---

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
পুরান ঢাকার চকবাজারে যে ভবন থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সূত্রপাত বলে জানা গেছে সেই ওয়াহেদ ম্যানশনে এখনো শতাধিক কনটেইনার রাসায়নিক পদার্থ মজুদ আছে। শুধু কনটেইনার নয়, শতাধিক ব্যাগভর্তি রাসায়নিক পদার্থ ও প্লাস্টিকের পণ্য তৈরির দানাও রয়েছে। যেগুলোর নূন্যতম বিস্ফোরণে ওয়াহেদ ম্যানশনের মতো কয়েকটি ভবন উড়ে যেতে পারে। বুধবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওয়াহেদ ম্যানশন। অগ্নিকাণ্ডে ৬৭ জন নিহতের ঘটনায় ‘ওয়াহেদ ম্যানশন’ ভবনে রাসায়নিক পদার্থ থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তদন্ত কমিটি। ওয়াহেদ ম্যানশনে শুক্রবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির নিচতলা থেকে শুরু করে প্রতিটি ফ্লোরই আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু নিচতলার একটি গোডাউনে এখনো প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক পদার্থ অক্ষত অবস্থায় মজুদ রয়ে গেছে। শুধু ওয়াহেদ ম্যানশন নয়, এর আশপাশের ভবনগুলোতেও এভাবে রাসায়নিক পদার্থের মজুদ ও ব্যবসা করা হতো। মূলত যে কয়টি ভবন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এসব ভবনের সবকটির নিচে রয়েছে প্লাস্টিকের দানা, বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের দোকান বা গোডাউন। ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় থাকা একটি টেইলার্সের দর্জি শামসুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ওই দিন আমরা একটু আগেই দোকান বন্ধ করে চলে যাই। কারণ ২১ ফেব্রুয়ারি, কাস্টমারও তেমন আসবেন না। দোকান বন্ধ করে আগে চলে যাওয়ায় আমরা রক্ষা পাই। পাশের কয়েকটি দোকান দেখিয়ে দিয়ে শামসুল বলেন, এগুলোতে প্লাস্টিকের দানা ও বিভিন্ন কেমিক্যাল বিক্রি হতো। এসব দোকানি প্রায় ৩০-৩৫ বছর এই এলাকায় ব্যবসা করে যাচ্ছেন। শুক্রবার সকালে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন পরিদর্শন শেষে এক ব্রিফিংয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান বলেন, ‘হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন’ ভবনে নিশ্চিতভাবেই রাসায়নিক পদার্থ ছিল। সেইসঙ্গে ওই ভবনে কোনো ধরনের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল না। এক প্রশ্নের জবাবে জুলফিকার রহমান বলেন, এই ভবনে যে পাউডার পাওয়া গেছে, সেগুলো রাসায়নিক পদার্থ ছিল। এখানে যেসব প্লাস্টিকের বোতল পাওয়া গেছে, সেগুলোও রাসায়নিক পদার্থে ভর্তি ছিল। যিনি বলেছেন এখানে কোনো রাসায়নিক ছিল না, সে কথাটি সত্য নয়।
এদিকে, চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে পোড়া ভবনগুলো ভেঙেচুরে যাওয়া অবকাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাস্তা ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কারের কাজ করছেন। শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থলে দেখা যায়, চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনে পানি ছিটিয়ে ও ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। সিটি করপোরেশনের বড় একটি ট্রাকে পানি এনে রাস্তা ও আশপাশ পরিষ্কার করা হচ্ছে। এর মধ্যে নন্দকুমার দত্ত সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবনের নিচতলা থেকে পুড়ে যাওয়া একটি শিশুর হাতের খ-িতাংশ খুঁজে পান এক ব্যক্তি। এরপর সেদিকে ঘিরে ধরে লোকজন। এ সময় অনেকে মন ভার করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন আর আফসোস করছিলেন। চুড়িহাট্টার যে ভবনগুলোতে আগুন লেগেছে তার মাঝে একটি গোল চত্বর আছে। গোল চত্বরের একপাশে জড়ো করে রাখা হয়েছে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাড়ি, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের অবকাঠামো। ঠিক তার পাশে গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজনের ভিড়। পুরান ঢাকা ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা এসব মানুষ বুধবার রাতের আগুনের ভয়াবহতা দেখতে এসেছেন। সবার চোখেই বিস্ময় আর শোকের চিহ্ন। ঘটনাস্থল থেকে একটু দূরে কথা হচ্ছিল আরিফ হোসেন নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে। তিনি বলছেন, গত পরশু আগুন লাগার পর তিনি বিষয়টি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি। পরে আগুনের ভয়াবহতা দেখে দূরে ছিলেন। এরপর বৃহস্পতিবার একের পর এক মরদেহ দেখে এখন তাঁর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না, মন খুবই খারাপ লাগছে। সম্মান তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. নাজিব শাহরিয়ার। তিনি চুড়িহাট্টা এলাকায় একটি মেসে থাকেন। তিনি বলছেন, পুরান ঢাকার বেশির ভাগ বাড়ির নিচে বিভিন্ন ধরনের গোডাউন ভাড়া দেওয়া। এসবের পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, বাসা ভাড়া বা মেস ভাড়া দিলে গ্যাস-পানির সংযোগ দিতে হয়। গোডাউন ভাড়া দিলে এসবের ঝামেলা থাকে না এবং ভাড়াও বেশি পাওয়া যায়। মো. নাজিব শাহরিয়ারের দাবির পক্ষে অনেক প্রমাণও পাওয়া যায়। চুড়িহাট্টা এলাকা চকবাজারের মধ্যে হওয়ায় সেখানে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। তবে এই এলাকা থেকে একটু ভেতরে গিয়েও বিভিন্ন ভবনে বিভিন্ন নামে গোডাউন দেখা গেছে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজ চলার সময় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখানে ভবনগুলোর মধ্যে সুগন্ধির ক্যান ছাড়াও লাইটার রিফিল করার ক্যান ছিল। এগুলো সব অবশ্যই কেমিক্যাল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ করার জন্য ১১ সদস্যর কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন কমিটির সদস্যরা। এ সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটির সদস্য বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার বিম ও কলাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনের সাপোর্ট ধরে রাখতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।

চুড়িহাট্টা মসজিদের জুমার দোয়ায় কান্নার রোল: ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনের কর্মীরা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন দেখভাল করছিলেন। এর মধ্যে জুমার নামাজের আযান হয়ে যায়। এরপর মসজিদে আসা লোকজনের জন্য আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে থাকে। এ ছাড়া ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ হাজি সেলিমও চুড়িহাট্টা মসজিদে নামাজ পড়েন। এ সময় মসজিদের ইমাম নিয়মিত খুতবা পাঠ করেন। জুমার নামাজ শেষে ইমাম যখন মোনাজাত ধরেন, তখন মসজিদের বাইরেও অনেক মানুষের জটলা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এসব মানুষও তখন ইমামের সঙ্গে মোনাজাতে শরিক হন। ইমাম যখন মোনাজাত করছিলেন, তখন মসজিদের ভেতর থেকে মুসল্লিদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। এ সময় চারপাশে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছিল আর শুধু ইমামের দোয়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। মসজিদের বাইরে থাকা অনেক মানুষ এ সময় অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। অনেকে স্বজন না হারিয়েও ঘটনার ভয়াবহতা আর এত মানুষের মৃত্যুতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। ঘটনাস্থলে এখনো ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট পর্যবেক্ষণের কাজ করছে। ঘটনাস্থলের চারটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ভবনগুলোতে ব্যানার লাগিয়ে দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:২৩:৪০ ● ৫০১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ