বাউফল(পটুয়াখালী) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
গ্রুপিং রাজনীতি আর নেতৃত্বের দ্বন্দের কারণে চরম অস্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছে বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগের তৃণমূল নেতা কর্মীরা। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এই দ্বন্দের বিরুপ প্রভাব পড়ছে আওয়ামীলীগ সমর্থকদের মধ্যেও। বিগত ৪৩ বছর ধরে বাউফল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে রয়েছেন স্থানীয় সাংসদ আসম ফিরোজ। পটুয়াখালী-২আসন থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগ চলছে তাঁর নেতৃত্বে। অন্যদিকে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত বাউফল পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন চান স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জিয়াউল হক জুয়েল। কিন্তু আসম ফিরোজ সমর্থন দেন তৎকালীন বাউফল পৌর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া পান্নুকে। ওই নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করে জয়ী হন মেয়র জুয়েল। সেই থেকেই এই দ্বন্দের সূত্রপাত।
গত কয়েক বছরে এ দুই গ্রুপের মধ্যে অন্তত অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, যাতে প্রাণ হারিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের ৭জন নেতাকর্মী। সর্বশেষ এমপি এবং মেয়র গ্রুপের সংঘাতে প্রাণ হারায় যুবলীগ কর্মী তাপস। এর বাইরে আসম ফিরোজ এমপি অনুসারী দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র কওে প্রাণ হারায় কেশবপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের বর্তমান সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালেহ উদ্দিন পিকুর দুই ভাই রকিব উদ্দিন রুমন ও ইশাদ তালুকদার। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আবদুল মোতালেব হাওলাদারকে লাঞ্ছিত করেন কেশবপুর ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের সভাপতি সালেহ উদ্দিন পিকুর স্বজনরা।
এসব সহিংস ঘটনায় করা মামলায় আসামি স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মী। সম্প্রতি, এই দ্বন্দে ঘি ঢালছেন স্থানীয় সাংসদের অনুসারী বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদার। তিনি তাঁর ফেসবুক একাউন্ট থেকে স্থানীয় সাংসদ আসম ফিরোজকে ইঙ্গিত করে তুলছেন একের পর এক অভিযোগ। দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব বিষয় নিয়ে উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আসম ফিরোজের সাথে আবদুল মোতালেব হাওলাদারের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি পৌঁছেছে চরমে। সর্বশেষ গত ১৫ই আগষ্ট বগা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ আয়োজিত শোক সভায় আবদুল মোতালেব হাওলাদারের ছেলে বগা ইউয়িন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হাচান হাওলাদার আসম ফিরোজ এমপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও বাউফল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব হাওলাদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসম ফিরোজ এমপি সবসময়ে আওয়ামীলীগকে কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছেন। তাঁর নিজের বাইরে তিনি আর অন্য কাউকে মর্যাদা দিতে চান না। এ কারনেই বাউফলে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীরা দ্বিধা দ্বন্দে ভূগছেন।
এমপি-মেয়র দ্বন্দের পাশাপাশি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আবদুল মোতালেব হাওলাদারের বর্তমান অবস্থান নিয়ে স্বস্তিতে নেই বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগের তৃণমূল নেতা কর্মীরা।
কাছিপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সদস্য মো. বারেক হাওলাদার(৬৫) বলেন, আওয়ামীলীগ করেও সব সময় একটা অদৃশ্য শঙ্কার মধ্যে থাকতে হয় আমাদের। যারা জীবনে আওয়ামীলীগের নাম বলে নাই তাদেরকে আওয়ামীলীগ বানিয়ে বাউফলে মেয়র জুয়েল আওয়ামীলীগের নেতা হবার চেষ্টা করছেন। বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন। এ কারনেই বাউফলে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীরা শিকার হচ্ছে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া বাউফলে এই বিশৃঙ্খল পরিবেশ বন্ধ হবে না বলে মনে করেন তিনি।
একই ধরনের কথা জানান, ধূলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল গনি হাওলাদার, কেশবপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের আওয়ামীলীগ সভাপতি মো. জাহাঙ্গির সিকদার, বাউফল সদর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রবীন সদস্য ইসমাইল মুন্সীসহ বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগের বিভিন্ন ওয়ার্ড এবং ইউনিট পর্যায়ের নেতা কর্মীরা।
অবশ্য আওয়ামীলীগের তৃনমূল নেতা কর্মীদের এমন মনোভাবের সাথে একমত নন মেয়র জুয়েল অনুসারী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ কৃষকলীগের পটুয়াখালী জেলা শাখার সহ সভাপতি এস এম ইউসুফ। তিনি বলেন, বাউফলে আসম ফিরোজ সাহেব ৭বার এমপি। তাঁর ওই জায়গাটায় অনেকে যেতে চান সে কারনেই কিছু বিরোধ বিভাজন আছে। মতলেব হাওলাদার এবং মজিবর মুন্সী যে আচরণ করছেন এর জন্য আসম ফিরোজ সাহেব নিজেই দায়ী। তিনিই তাদেরকে নেতৃত্বে এনেছেন। তাঁর অদূরদর্শী চিন্তার অভাবেই আজকে বাউফলে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীদের এই অস্বস্তি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ ছাড়া বাউফলে এই সমস্যা সমাধানের আর কোনো রাস্তা নেই বলেও মনে করেন এই কৃষকলীগ নেতা।
মেয়র জিয়াউল হক জুয়েলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত বাউফল উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হাচান মৃধা বর্তমান অস্বস্তিকর বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আসম ফিরোজ এমপির ব্যার্থ নেতৃত্বের কারনেই ঘটছে এসব অস্বস্তিকর ঘটনা।
এ বিষয়ে বাউফল পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি ইব্রাহিম ফারুক বলেন, কেবল অস্বস্তি না বাউফলে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীরা সব সময়ে আতঙ্কে দিন কাটায়। মেয়র জিয়াউল হক জুয়েল বরিশালের প্রভাবশালী এক আওয়ামীলীগ নেতা এবং বাউফলের সন্তান সরকারের এক আমলার ছত্রছায়ায় থেকে বিএনপি জামাতের কিছু লোক নিয়ে বাউফলে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীদের উপর সন্ত্রাসী তান্ডব চালাচ্ছেন । আমিসহ অনেক নেতা কর্মীরা তাদের হামলা নির্যাতনের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি। তাদের হামলায় আমি আমার একটি চোখ হারিয়েছি। বাউফলের মাটি ও মানুষের নেতা আসম ফিরোজকে অসম্মান করে তাঁরা কথা বলেন। আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীদের কাছে এগুলোই সব থেকে বড় অস্বস্তি। এই অস্বস্তি থেকে পরিত্রাণের রাস্তা কি জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি নিরপেক্ষ একটি তদন্ত টিম বাউফলে পাঠান এবং সেই তথ্য অনুযায়ী তিনি যদি ব্যবস্থা নেন তাহলেই স্বস্তি ফিরবে বাউফলে আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীদের মধ্যে।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক বাউফল পৌর মেয়র মেয়র জিয়াউল হক জুয়েলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাউফলে এই অস্বস্তিকর পরিবেশের জন্য দায়ী স্থানীয় সাংসদ আসম ফিরোজ। তিনি বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে আওয়ামীলীগের অনেক ত্যাগী নেতা কর্মীকে হয়রানি করছেন। এসব মিথ্যা মামলার কারনেই এই অস্বস্তিকর পরিবেশ চলছে বাউফলে। আওয়ামীলীগ নেতা হিসেবে এই অস্বস্তির জায়গা থেকে পরিত্রাণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারন সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল ভাইকে জানানো হয়েছে। তাঁরা এই সমস্যা সম্পর্কে অবগত আছেন। তাঁরা এই সকল সমস্যা নিরসনে কাজ করবেন।
এ বিষয়ে বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও স্থানীয় সাংসদ আসম ফিরোজ এমপি বলেন, বাউফলে মেয়র জুয়েল বিএনপির কিছু দলছুট সুবিধাভোগী কিছু নেতাকর্মীদেরকে নিয়ে বাউফলে আওয়ামীলীগের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির পায়তারা করছেন। আমার দলের কর্মীদের হত্যা করছেন। দলের নেতা কর্মীদের হত্যার দাগ যাদের হাতে সেই মেয়র জুয়েলের সাথে এখন হাত মিলিয়েছেন মোতালেব হাওলাদার। সঙ্গত কারনেই দলের নেতা কর্মীরা খুনীদের সাথে তাঁর এই মেলা মেশা ভালো চোখে দেখছেন না। সামগ্রিক এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিষয়টি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা জানেন কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এসব অশুভ তৎপড়তা বন্ধে তাদের দৃশ্যমান কোনো উদ্দোগ দেখছি না। তবে বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগ সব সময়েই ঐক্যবদ্ধ ছিলো এবং আছে। আমি বিশ্বাস করি এসব অশুভ তৎপড়তা যারা চালাচ্ছেন তাদের বিষয়ে দল অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহন করবে।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি কাজী আলমগীরের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের মূল ¯্রােতেই রয়েছে বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগ। বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগের বাইরে সেখানে কাউকে পৃথকভাবে সংগঠন করার অধিকার দেয়া হয়নি। বাউফলের পৌর মেয়র জুয়েল সেখানে দলীয় ব্যানারে যেসকল কর্মকান্ড পরিচালনা করেন তা জেলা আওয়ামীলীগের কনসার্নের বাইরে। এ বিষয়ে বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে আমি খুব স্পষ্ট করে বলেছি। বাউফল উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মোতালেব হাওলাদার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছেন। তাঁকে একাধিকবার মোবাইল করে এসব কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি। বাউফলের বর্তমান অবস্থা সামনের দিনেও বিরাজ করলে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙের বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহন করবে জেলা আওয়ামীলীগ।
এসএস/এমআর