মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥
আজ ৫জুন। বিশ্ব পরিবেশ দিবস। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন কেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনপদে দিবসটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। নদী-খাল-সাগর বেষ্টীত কলাপাড়া উপজেলায় এখন পরিবেশ সচেতন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু খাল, পুকুর, জলাশয়, বিল নদী দখল দৌরাত্ম্য বেড়েছে তার চেয়েও বহুগুনে। বাড়ছে শতগুন বেশি দখলদার।
কলাপাড়া উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব দর্শনে চলছে উন্নয়ন মহাযজ্ঞ। পায়রা বন্দর, একাধিক তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, শের-ই-বাংলা নৌঘাটি, কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র। নির্মাণ হয়েছে ফোরলেন সড়ক, হচ্ছে নির্মাণ ফুটপাথসহ আরও ফোরলেন সড়ক। এই উন্নয়নকে কেন্দ্র করে আকাশ ছোয়া দাম বেড়েছে জমিজমার। এ কারণে দখলদারিত্ম বেড়েছে শতগুন। নদী, খাল, পুকুর, জলাশয় কোন কিছুই দখল থেকে রক্ষা হচ্ছে না। ফলে এই উপজেলার মানুষের জীবন-যাত্রা থেকে শুরু করে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কৃষি উৎপাদনের স্বার্থে ষাটের দশকে উপকূলীয় কলাপাড়ায় ৩০৮ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ করা হয়। লোনা পানির প্রবেশ ঠেকাতে কৃষি আবাদ নিশ্চিতে এই বাঁধ করা হয়। এছাড়া অভ্যন্তরীন খালে মিঠা পানি সংরক্ষণ করতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়। পাশাপাশি পানি নিষ্কাশনের সুবিধার্থে করা হয় ১০৫টি স্লুইস নির্মাণ। ভিতরের খালের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে এই স্লুইস। ৪৭টি ফ্লাসিং এবং ৫৮টি ড্রেনেজ স্লুইস করা হয়। স্ল্ইুস যথাযথ নিয়ন্ত্রণে জমি অধিগ্রহণ করে স্লুইস সংলগ্ন এলাকায় একটি করে একতলা পাকা বাড়ি এবং একজন করে স্লুইস খালাসি নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি স্লুইস খালাসি নিয়োগ বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। এরপর থেকে কৃষকের দূর্ভোগ বাড়তে থাকে। স্লুইস খালাসি ভবন থেকে জায়গা, এমনকি স্লুইসগেটের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় একশ্রেণির মাছ ধরার প্রভাবশালী লোকজনের কাছে। শুরু হয় অভ্যন্তরীন খালের দখল ও ভরাট। পরিবেশ-প্রতিবেশ কৃষকের প্রতকূলে চলে যায়। সরকারি দলের এক শ্রেনির ক্যাডার স্লুইস এবং খালের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। স্লুইসগুলো পরিণত হয় অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। এর সঙ্গে হাত মেলায় ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারসহ কতিপয় কর্মচারী এবং একশ্রেণির দালাল। তারা পানিতে টই-টুম্বুর থাকা খাল থেকে শুরু করে ভরাট খাল, নদীতীরকে চাষযোগ্য কৃষিজমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়। ফলে কৃষকের কপাল পুড়তে থাকে। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় ভয়াবহভাবে। এমনকি কলাপাড়া পৌরশহরের চিঙ্গরিয়ার খালটিতে এখনও শুকনো মৌসুমে কোমর সমান পানি রয়েছে। অথচ আশির দশকের মাঝামাঝি কৃষি জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। এমনতর অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে কৃষকের। বর্তমানে খালটি দখল করে আটকে দেয়ায় পারিবারিক বর্জ্যরে দূষণে বাস উপযোগিতা হারিয়ে ফেলছে।
এদিকে দখল, ভরাট প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলেও কলাপাড়ায় উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ সরকার শুরু করলে ২০১০ সালের পর থেকে খাল দখলের মহোৎসব শুরু হয়েছে। নদী তীরে পাকা-আধাপাকা স্থাপনা। খাল দখল-ভরাট করে পুকুর বাড়ি করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। অথচ পরিবেশ আইনে বলা হয়েছে জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট কিংবা শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবেনা। জাতীয় পানি নীতি অনুসারে নাব্যতা ও যথাযথ নিষ্কাশন ব্যবস্থা রক্ষায় জলপথের পলি অপসারন করা সরকারের একটি কর্র্তব্য। এক তথ্য মতে, কলাপাড়ায় ২১ একরের উপরে ২৭টি এবং ছোট ৬৮টি খাল ২০০৫ সালে সরকারিভাবে ইজারা দেয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০০১ সালেও তাঁরা সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে কলাপাড়ার গুরুত্বপূর্ণ ৮৭ টি খাল পুনর্খনন করা প্রয়োজন মর্মে তালিকাসহ অবহিত করেন। যার দৈর্ঘ প্রায় ২৫৮ কিলোমিটার। ২০০৫-২০০৬ সালেও ফের এ প্রস্তাবনা পাউবোর উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে প্রত্যেক বছর ৫-১০টি খাল পুনর্খনন করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ছাড়াও বিএডিসি, মৎস্য বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন প্রকল্প খননের কাজ করছে। বর্তমানেও বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে কুয়াকাটায় খাল পুনর্খননের কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু পরিবেশবাদীদের দাবি স্থানীয় জনগোষ্ঠী; যারা এই খালটি ব্যবহার করবেন, খালের পানি ব্যবহার করে কৃষিকাজ করবেন, তাদের মতামতের ভিত্তিতে গুরুত্ব অনুসারে ওই খালটি প্রথমে খনন করতে হবে। এছাড়া খালের সীমানা আগে চিহ্নিত করে তারপরে পুনর্খনন করা প্রয়োজন; নইলে উল্টো খালটি ভরাট হয়ে বেদখল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
উন্নয়ন ও পরিবেশ কর্মী কামাল হাসান রনি জানান, আমরা বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) থেকে একথা বার বার বলে আসছি কিন্তু স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মতামতের কোন প্রতিফলন ঘটছে না। ধুলাসার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল আকন জানান, তার ইউনিয়নের কাচারির খালটি কৃষকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এই খালটিকে চাষযোগ্য জমি দেখিয়ে আশির দশকে কয়েকজনকে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। এই অপকর্ম বন্ধ না করলে খাল, জলাশয় রক্ষা সম্ভব নয়। আর খাল পুনর্খননের জন্য কখনও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের মতামত নেয়া হয়না। নেই কৃষিবিভাগের সঙ্গে সমন্বয়।
মহিপুর এবং ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের একাধিক কৃষক জানান, সোনাতলা নদীর সঙ্গে খাপড়াভাঙ্গা নদীসহ ডালবুগঞ্জ শাখা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত গাববাড়িয়া নদীতে কয়েক বছর আগে ক্লোজার করা হয়েছে। এখানে একটি গার্ডার ব্রিজ করার জন্য মালামাল পর্যন্ত নেয়া হয়েছিল। অথচ অজ্ঞাত কারনে সেখানে নদীটি বাঁধ দিয়ে ক্লোজ করে দেয়া হয়। ফলে পর পর তিনটি বছর অন্তত ৪০টি গ্রামের কৃষক জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছেন। ওখানে স্লুইস করার কথা থাকলেও আজ অবধি করা হয়নি। বর্তমানে গাববাড়িয়া ক্লোজারের কারণে প্রায় ১৫টি স্লুইস সংযুক্ত খাল মরে যাওয়ার পথে। পানির প্রবাহ নেই। এভাবে সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তব এবং পরিবেশ সম্মত সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উন্নয়ন কাজও খাল, নদী ভরাটের কারণ হয়ে যাচ্ছে। আর ভূমি অফিসের দুর্নীতি আর ভুল সিদ্ধান্তের কারনেও উপকূলীয় কলাপাড়ার শতাধিক খাল ও কয়েক শ’ শাখা খাল ভরাট ও দখলের কারণে কৃৃষিকাজে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এমনকি পৌরশহরে বসবাস উপযোগিতা হারিয়ে ফেলছে মানুষ। কুয়াকাটা পৌরসভার মানুষের অভিযোগে কচ্ছপখালী লেকসহ সংযোগ খালটি দুই বছর ধরে পুনর্খনন চলছে। খাল দখলদারদের পাকা সিসি কলাম রেখে তারপরে খালটি নামকাওয়াস্তে পুনর্খনন করা হচ্ছে। কখনও কখনও এসব দখল দৌরাত্ম বন্ধে অভিযানও চলে। করা হয় তালিকা। কিন্তু শতাধিক খাল দখল করে, ভরাট করে পুকুর করা হয়েছে, বাড়ি করা হয়েছে তাদের তালিকা পর্যন্ত করেনি স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা (তহশিলদার)। যাচ্ছে বেহাত হয়ে।
এমইউএম/এমআর