মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া সাগরকন্যা অফিস॥
গৃহিনী হামিদা বেগমের মেয়ে নাতি-নাতনি নিয়ে আটজনের সংসার এখন বেড়িবাঁধের উপরে। বাড়ি-ঘর ইয়াস-পূর্ণিমার অস্বাভাবিক জোয়ারের ঝাপটায় লোনা পানির প্লাবনে একাকার। ঘরের পিড়ার মাটি পর্যন্ত গলে গেছে। হাঁস-মুরগী মরে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পলিথিনের ছাপড়ায় বাঁধেই (আনুমানিক ১০ ফুট লম্বা আর চার/পাঁচ ফুট প্রস্থ ) বসবাস। জানালেন হামিদা বেগম, তিন দিন আগে বালিয়াতলী ইউনিয়নের এক আত্মীয় নুরু হাওলাদারের বাড়ি থেকে পাঠানো রান্না করা ভাত দিয়ে তিনদিন চলছে। এখন আলগা চুলায় রান্নার চেষ্টা করছেন।
বেলা ১১টায় কারও পেটে কিছু পড়েনি। আরেক গৃহবধূ ডালিয়া বেগম। স্বামীসহ পাঁচজনের সংসার। অন্য ইউনিয়ন চরবালিয়াতলী গ্রামে থাকা জামাই শাকিল তার বাড়ি থেকে রান্না করা পাঠানো খাবার খাইয়ে তিনদিন চলছে। অন্যের বোটে (ট্রলারে) কাজ করার আয় দিয়ে চলে এ পরিবারের। তিনটি ইটের চুলাটি এখানকার চারটি পরিবারে রান্না-খাওয়ার ভরসা। ইয়াসের ঝাপটায় লোনা পানির প্লাবনে ঘরবাড়ি-পুকুর সব নষ্ট। নৌকায় করে পাশের ইউনিয়ন থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন। একই দশা বৃদ্ধা রুশিয়া বেগমের। সংলগ্ন স্লুইস গেটে ধরা কয়েকটি মাছ কোটাকুটি করছিলেন। সকাল ১০টা পর্যন্ত পেটে কিছু পড়েনি। রাতেও উপোস করেছেন। ছোট্ট শিশু মরিয়মকে অন্যবাড়িতে নিয়ে কিছু খাইয়েছেন। স্বামী আলাম গাজী হোন্ডা দূর্ঘটনায় এক বছর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ছেলে বউ, মেয়ে-ছেলে নিয়ে আট জনের সংসারে এখন হাহাকার। চালডাল কিছু ছিল তা লোনা পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। চারদিন ধরে বেড়িবাঁধের ওপরে এ পরিবারটির পলিথিন, তালপাতার বেড়ায় বসবাস। একেকটি ঝুপড়িতে গড়ে সাত-আটজন কোনমতে রাত কাটায়। দিনের বেলা ঘুরে-ফিরেন কর্মের আশায়। তাও জোটেনা। জসিম প্যাদা-ঝর্ণা বেগম দম্পতির চারজনের সংসার। এখনও বাঁধের উপরের ঝুপড়ি ঠিক করছেন।
হামিদা বেগম জানালেন, নিকটের একজনে ভিজিএফএর চাল পেয়েছেন তা ধার এনে কাটছে একেক বেলা। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের চান্দুপাড়া গ্রামের প্রায় শত মধ্যবিত্ত কিংবা নি¤œবিত্ত পরিবার সব পানিবন্দী দশায় একই দূর্ভোগে পড়েছেন। রাবনাবাদ পাড়ের বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে ইয়াস ও পুর্ণিমার জলোচ্ছ্বাসে গ্রামটির ভিতরে ঢোকা কোমর থেকে বুক সমান পানি পাচদিনেও নামতে পারেনি। স্লুইস দিয়ে নেমে শেষ হয়না বলে জানান দূর্গত এসব মানুষ। মুক্তিযোদ্ধা বাজারের প্রায় আধাকিলোমিটার পর থেকে বেড়িবাঁধের উপরে দক্ষিণদিকে এ মানুষগুলো বাড়িঘর ছেড়ে এখন আশ্রয় নিয়েছে বাঁধের উপরে। মানুষগুলো চরম মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। গোসলসহ ব্যবহারের পানি নেই। আর্থিক সঙ্কটে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। প্রায় তিন কিলোমিটার বাঁধের উপরে প্রায় শত পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। এখনও কেউ কেউ ঝুপড়ির ঘর তুলছেন। ফাতেমা বেগম-শাকিল দম্পতির চারজনের সংসার। ট্রলারে ( বোটে) কাজ করেন। ৬৫ দিনের অবরোধ। বেকার। ঘরে হাটু সমান পানি। ইটের কিংবা মাটির আলগা চুলাই ভরসা। তাও যার আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে তার পক্ষে পেটে ভাতের যোগান দেয়া সম্ভব। বাকিরা কষ্টে আছেন। হাসিব জানায় সবকিছু লোনা পানির নিচে। খাবার-ব্যবহারের পানি পর্যন্ত অন্য ইউনিয়ন থেকে আনতে হচ্ছে। শনিবার সকালে গিয়ে এ মানবিক দৃশ্য দেখা গেছে। চতুর্থ শ্রেণির রাকিব জানায়, ঝুপড়ির নিচের তক্তার পাটাতনে পাঁচটি মানুষ আতঙ্কে রাত কাটাই। কেউ বসে থাকে। কেউ একটু ঘুমিয়ে নেয়। এমনি পালা করে রাত কাটছে।
শাকিল প্যাদা জানান, বাবা-মাসহ আটজনের সংসারে এখন তালপাতা, খেজুর পাতা, পলিথিন ভরসা। রান্না তো চলে না। মহসিন হাওলাদার চেষ্টা করেছিলেন বাড়িতে থাকতে। না পেরে আজ শনিবার সকাল থেকে মাটি কেটে বাঁধের উপর একটু জায়গা উচু করে সেখানে ঝুপড়ি করছেন। চারজনের সংসার এখন অচল শ্রমজীবী মানুষটির। জানালেন, নদীর পানিতে ফিটকিরি দিয়ে ব্যবহারের কাজ করছেন। রাকিবুল আকন জানালেন, একটি ঝুপড়ির মধ্যে দুই ফ্যামিলির সাত জনে তিনদিন তিন রাত থেকেছি। একটা চুলায় চার পরিবার রান্নার চেষ্টা করছি। সাজিম হওলাদার জানান, একটি পলিথিনের নিচে ছয় জনের সংসার। রান্না করছিলেন রোজিনা বেগম; জানালেন, ২০০৭ সালের সিডরের পরে এতো বেশি পানির প্রবেশ আর দেখেননি। ফয়সাল আকন জানান, চাল-চুলা সব গেছে। হাস-মুরগি নেই। মরে গেছে। গবাদিপশু পর্যন্ত পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব মানুষের এখন জরুরি ভিত্তিতে চাল-ডালসহ খাবার সহায়তা প্রয়োজন বলে সবাই জানালেন। তবে মানুষগুলো জানান, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের থেকে কিছু শুকনো খাবার পেয়েছেন। দু’একজনে কিছু ত্রাণও পেয়েছেন। মানুষগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চিয়তার হতাশা কাজ করছে। মানবেতর জীবন-যাপনে দিশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কবে পানি নামবে। কবে ঘরবাড়ি কীভাবে ফের ঠিক করবেন এসব ভেবে অস্থির। কবে নাগাদ ফের ঘরে ফিরবেন তাও জানেন না। দরিদ্র এ মানুষগুলোর অভিযোগ হোন্ডায় আইয়া একজনকে ত্রাণ দিয়ে ফেসবুকে ছাইর্যা দেয়। কাজের কাজ কিছুই অয়না। এসব মানুষ ত্রাণের চেয়েও পানির বন্দীদশার লাঘব চেয়েছেন।
লালুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শওকত হোসেন তপন বিশ^াস জানান, অধিকাংশকেই চাল-ডাল দেয়া হয়েছে। কোন সঙ্কট নেই। তারপরও অর্ধশত পরিবার পানিবন্দীর কারণে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন যাদের দুই এক জনের যার দরকার তাকেই খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক জানান, সরকারের দেয়া সহায়তা স্ব স্ব ইউপি চেয়ারম্যানকে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারপরও কারও কোন খাদ্যসহ কোন সমস্য থাকলে বাড়ি পৌছে দেয়া হবে।
এমইউএম/এমআর