জাহিদ রিপন, সাগরকন্যা অফিস॥
পূর্ণবাসনের আগে উচ্ছেদ নয়-প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় চলছে নানা উন্নয়ন প্রকল্প নির্মাণের জমি অধিগ্রহণ। ফলে আচমকা নোটিশে উচ্ছেদের শিকার ক্ষতিগ্রস্থরা বাপ-দাদার বসতভিটে, কবর হারিয়ে বুকে দীর্ঘশ^াস নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন অনিশ্চয়তার পথে।
শুধু তাই নয় সক্রিয় মধ্যস্বত্ত্বভোগী চক্রসহ ভ’মি অধিগ্রহন অফিসের পার্সেন্টিজের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ায় দরিদ্রসহ নি¤œমধবিত্ত এসব পরিবারে মানুষগুলো হয়ে পড়েছেন দিশেহারা। সংশ্লিস্টদের দপ্তরে গিয়ে মিলছে না সুরু। তাই প্রতিকারে হস্তক্ষেপ কামনা করছেন প্রধানমন্ত্রীর।
সরজমিনে জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের চারিপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সহ¯্রাধিক জেলে ও কৃষক পরিবারের ঘনবসতি পুর্ণ গ্রামটির কোন ভিটিতে ঘর নেই। বহু ফলন্ত নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে পুরনো বাড়ির স্বাক্ষী হয়ে। অনেকে ঘর ভেঙ্গে পলিথিন, কাপড়ের ছাপড়া দিয়ে বাস করছেন। গোছগাছ করছেন ঘরের হাড়ি-পাতিলসহ সামান্য অসবাপত্র। কেউবা মাথায় করে নিয়ে মালামাল তুলছেন ভ্যানে। স্মৃতি বিজরিত ভিটায় চোখের বানে শেষ রান্না করছেন বেশ কয়েকজন গৃহীনি।
পায়রা বন্দর নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের আওতায় বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়া এই মানুষগুলো জানান, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের নয় তারিখে চারিপাড়া গ্রামের সহ¯্রাধিক পরিবার তাদের বাড়িঘর ছাড়ার আচমকা নোটিশ পেয়েছেন। অনিশ্চয়তা নিয়ে তাই বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বেরিবাঁধ বিধ্বস্ত এ জনপদের ক্ষতিগ্রস্থ এসব মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় নানা হৃদয় বিদারক কথা।
তিন দফা জমিজমাসহ বসতভিটা গিলে খেয়েছে রাবনাবাদ নদী। এরপর ৩০ বছর পূর্বে বেড়িবাঁধের আধা কিলোমিটার ভেতরে বাড়ি করেছেন পঞ্চাশোর্ধ জাহানারা বেগম। তাও ফেলে এখন তিন কিলোমিটার দূরে পশুরবুনিয়ায় বাঁধের ঢালে বৃদ্ধ স্বামী আনোয়ার হোসেনসহ আশ্রয় নিয়ে শুরু করেছেন জীবন যুদ্ধ।
অসুস্থ শিরিন-লতিফ প্যাদা দম্পতি জানান, বড় ছেলে এইচএসসি পাশ করেও বেকু মেশিন চালায়। মেজ ছেলে ডিপ্লোমা পড়ছে। সাগরে মাছ ধরে স্বামীর আয়ে চলছে ছয়জনের সংসার। নোটিশ পেয়ে ঘরটি ভেঙ্গে এখন রাত কাটছে ঝুপড়িতে। ঘর, গাছপালা বাবদ নয় লাখ টাকা পাওয়ার কথা জানলেও দালালের অভিযোগে টাকা তুলতে পারছেন না।
ব্রিটিশ আমল থেকে তিন পুরুষের বসতি চারিপাড়ার ৭০ বছরের পুরনো বাড়িঘরসহ বাবার কবর ছেড়ে চলে এসেছেন হানিফ হাওলাদার। জানান, এখন মাসে তিন হাজার টাকায় বানাতিবাজারের ভাড়া ঘরে ১১ জনের বসবাস। নয় লাখ টাকা ঘরের ক্ষতিপুরন পেয়েছেন। টাকা তুলতে প্রতি লাখে আট হাজার দিতে হয়েছে দালালকে। ধার-দেনা পরিশোধ করে দুই লাখ টাকা অবশিষ্ঠ রয়েছে।
জাহানারা জানান, পরিবারের সদস্যরা, ঘর এবং গাছপালার ক্ষতিপুরনের টাকা তুলেছেন। তাতে এলএও অফিসসহ দালালকে দিতে হয়েছে শতকরা ৮-১২ টাকা। জমির টাকা কবে পাবেন তা অনিশ্চিত। আফজাল-মাহিনুর দম্পতিও ঘরের টাকার জন্য দালালসহ এলএও অফিসে দিয়েছেন দুই লাখ টাকা।
যৌথ পরিবারে বসবাস করায় ক্ষতিপুরনের টাকা জোটেনি তরুণ দম্পতির রুবেল হাওলাদার-রোকসনার কপালে। দশকানি গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা জানিয়ে বলেন, তাদের যৌথ পরিবারের ক্ষতিপুরন তুলতে দালাল ও ভ’মি অধিগ্রহন (এলএও) অফিসকে দিতে হয়েছে ৯০ হাজার টাকা। ১৩ জনের সংসারে যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে মাথা পিছু এক কড়া জমিও কিনতে পারছেন না।
শাহিনুর বেগম বলেন, পায়রা বন্দরের অফিসাররা মাছ চাষ, হাস-মুরগি-গরু পালনের জন্য ২৪ দিনের প্রশিক্ষন দিয়েছেন। যেখানে পুনর্বাসনের নেই সেখানে এ ট্রেনিং দিয়ে কি করব? নয় মাসের শিশু হাবিবাকে নিয়ে লামিয়া-জাফর হাওলাদার দম্পতি কোথায় যাবেন জানা নেই। একইভাবে গৃহবধূ মাহিনুর, মোশারফ হাওলাদার, কুলসুম বেগমসহ শতধিক পরিবার জানেন না আদৌ তারা পুনর্বাসনের ঘর পাবেন কিনা।
বাড়িঘর হারা মানুষকে দ্রুত পুনর্বাসনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে লালুয়ার ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হোসেন তপন বিশ^াস ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে পুনর্বাসনের আগে এসব দরিদ্র মানুষকে বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া ঠিক হয়নি।
জেলা প্রশাসক মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী সাগরকন্যাকে বলেন, ভ’মি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের প্রতি প্রধানমন্ত্রীসহ জেলা প্রশাসন অত্যন্ত মানবিক। কেউ মধ্যস্বত্তভোগী বা দালালদের খপ্পরে পরলে এটি তাদের অজ্ঞতা। আমাদের নজরে আসলে আইনী ব্যবস্থা নিব।
জেআর/এমআর