ভূমি অধিগ্রহণ-কলাপাড়ায় ক্ষতিপুরণের টাকায় ভাগ বসাচ্ছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা!

প্রথম পাতা » পটুয়াখালী » ভূমি অধিগ্রহণ-কলাপাড়ায় ক্ষতিপুরণের টাকায় ভাগ বসাচ্ছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা!
সোমবার ● ১ মার্চ ২০২১


কলাপাড়ায় ক্ষতিপুরণের টাকায় ভাগ বসাচ্ছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা!

মেজবাহউদ্দিন মাননু, সাগরকন্যা অফিস॥


ডাকাত কিংবা লুটেরা বললেও যুৎসই হয়না। কিন্তু বাস্তবে এ দুটোই চলছে পায়রা বন্দরের অধিগ্রহণকৃত লালুয়ার বানাতিপাড়াসহ গোটা এলাকায়। একটি মধ্যস্বত্ত্বভোগী চক্র জমি ঘরবাড়ি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত মাানুষের ক্ষতিপুরণের টাকা লুটেরার মতো হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব সহজ-সরল মানুষকে জিম্মি করে ওই সিন্ডিকেটচক্র কোটি টাকা ইতোমধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে। এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। মানুষ এর থেকে পরিত্রাণ পেতে জেলা-উপজেলা প্রশাসন কিংবা পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের কোন সহায়তা পাচ্ছেন না। বরং কোন ভুক্তভোগী মানুষ এমন লুটপাটের প্রতিবাদ কিংবা টাকা দিতে রাজি না হলে তার ফাইলপত্র আটকে দেয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপুরনের বরাদ্দ থেকে শতকরা দশ থেকে কুড়ি ভাগ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
অতিসম্প্রতি চারিপাড়ার বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব শত শত অভিযোগ আর আহাজারি শোনা গেছে। শোনা গেছে মানুষগুলোর অসহায়ত্বের কথা। পায়রা বন্দরের উন্নয়নের স্বার্থে দাদা-বাপ এবং নিজেরসহ তিনপুরুষের ৬০-৭০ বছরের ভিটে-বাড়িঘর, ফসলি জমি ছেড়ে দিয়েছেন জেলে কিংবা কৃষক শ্রেণির এসব মানুষ। শেষ বারের মতো বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাওয়ার সময় চোখের পানিতে বুক ভাসানো মানুষগুলোর কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এখনও চলছে লুটপাট-ডাকাতি। কোন রাখ-ডাক নেই। লুটেরা এ চক্রের কালো থাবা থেকে রক্ষা পেয়েছেন এমন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। লালুয়ার কয়েকজন বর্তমান এবং সাবেক মেম্বার, সরকারি দলের সেখানকার নেতা, কলাপাড়ার দু’একজন দলিল লেখকের সমন্বয়ে এই মধ্যস্বত্ত্বভোগীচক্র গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে পটুয়াখালীর এলএও শাখার কয়েক কর্মচারী সরাসরি পার্সেন্টেজ হাতিয়ে নেয়ার কাজে জড়িত। কোন ব্যক্তি ক্ষতিপুরনের চেক তুলতে গিয়ে কমিশন না দিলে কাউকে দিয়ে সাদা কাগজে অভিযোগ কিংবা আপত্তি দিয়ে চেক আটকে তারপর মধ্যস্থতার নামে হাতিয়ে নেয় নির্ধারিত অঙ্কের কমিশন। লালুয়া কিংবা ধানখালীসহ অধিগ্রহনকৃত এলাকার মানুষ বারবার বলে আসছিল তাদেরকে কলাপাড়ায় বসে সহজ পদ্ধতিতে চেক কিংবা ক্ষতিপুরনের টাকা প্রদান করতে হবে। প্রথমে তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের জমি ও বাড়িঘরের ক্ষতিগ্রস্ত কিছু চেক কলাপাড়ায় হস্তান্তর করা হয়েছিল। এরপরে আর হয়নি। দালাল, লুটেরা এই চক্র এতোটাই প্রভাবশালী যে এদেরকে লাখ লাখ টাক দেয়ার পরও ভয়ে ভুক্তভোগী মানুষ মুখ খুলতে রাজি নয়। কমিশন আদায়কারী এচক্র দলমত সবাই ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।
চারিপাড়ার বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়া মানুষের অভিযোগ বর্তমান এবং সাবেক একাধিক মেম্বার মোঃ রবিউল ইসলাম, সাবেক মেম্বার মজিবর হাওলাদার, স্থানীয় রিপন গোলদারসহ অনেকের বিরুদ্ধে  ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের চেক ছাড় করে দেয়ার নামে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এরা ১০-১৩ পার্সেন্ট অর্থ হাতিয়ে নেয়। যে টাকা দেয়না তার ফাইলে জটিলতা দেখিয়ে; এমনকি ফাইল থেকে কাগজপত্র গায়েব করে চেক আটকে পার্সেন্টেজ দিতে বাধ্য করা হয়। চারিপাড়ার হানিফ হাওলাদার-শাহিনুর দম্পতি জানালেন, তালই থেকে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমল থেকে এখানে বসতি ছিলেন। এক একর জমিতে বাড়িঘর পুকুর সব সাজানো ছিল। এখন চলে গেছেন সব ছেড়ে ঘরের ক্ষতিপুরণ বাবদ নয় লাখ টাকা পেয়েছেন শতকরা আট টাকা করে দিতে হয়েছে মধ্যস্বত্ত্বভোগী চক্রকে। জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে বাড়িঘর ছেড়ে আসা এ মানুষটি এখন পেশা হারা। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া মাছ চাষ, গবাদিপশু পালনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ২৪দিন। কিন্তু কই পালন করবেন হাঁস-মুরগি কিংবা গবাদিপশু। থাকার জায়গাও নেই। মাসে এক লাখ টাকা আট হাজার টাকার কর্জে এনে মোষ কিনে আবার বিক্রি করছেন। মানুষটির চোখ দু’টি ছল ছল করছিল। ৭০ বছরের আনোয়ার হোসেন জানালেন জমির টাকা তুলতে শতকরা ১০টাকা দিতে হয়। স্থানীয় বর্তমান মেম্বার রবিউল, সাবেক মেম্বার মজিবর প্যাদা, হালিম, আনোয়ার এরা এই টাকা তোলার মধ্যস্বত্ত্বভোগী হিসেবে কাজ করছে বলে এন্তার অভিযোগ। শিরিন-লতিফ প্যাদা দম্পতি জানালেন, তাদের ক্ষতিপুরনের নয় লাখ টাকার এক টাকাও তুলতে পারেননি। কিন্তু দালালের পেছনে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। কামলা দিয়া এখন জীবিকার চাকায় যোগান দিচ্ছেন এ পরিবারের সদস্যরা। সুলতান হাওলাদার জানালেন, বাড়ির পাশের খাল থেকে প্রত্যেক মৌসুমে ৬০-৭০ হাজার টাকার মাছ পেতেন। এখন এই আয় গেছে। বাড়িঘর গেছে। জাহানারা বেগম জানালেন প্রথম বলা হয়েছে ক্ষতিপুরনের টাকার পর যার ঘর গেছে সেই ঘর পাবে। পুনর্বাসনের চেক পেলেও ঘর পাওয়া নিয়ে রয়েছেন অনিশ্চয়তায়। মোশাররফ হাওলাদার জানান, ক্ষতিপুরনের নয় লাখ ৭৩ হাজার টাকার চেক তুলতে দালালকে ৯০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। শত শত মানুষের কাছ থেকে অন্তত কোটি টাকা দালালরা হাতিয়ে নিয়েছে। সকল মানুষ এ দালাল চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। ডাকাতের মতো, লুটেরার মতো টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে জেলে-কামলা কৃষক শ্রেণির এসব দরিদ্র মানুষকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দম্পতি জানালেন তার ৩৩ শতক জমির ওপর বাড়িঘরের ক্ষতিপুরনের ১৬ লাখ টাকা উত্তোলন করতে দালাল শাহীনকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। ভয়ে এ দম্পতি এই কথাটি পর্যন্ত বলতে রাজি ছিলেন না। প্রবীন আইনজীবী জালাল তালুকদার বলেন, জমিজমা হারা বহু মানুষ ক্ষতিপুরনের টাকা না পেয়ে এখন ওয়াপদার রাস্তার ঢালে আশ্রয় নিয়েছেন। অভিযুক্ত সাবেক মেম্বার মজিবর হাওলাদার বলেন, ‘ এ্যা ভুয়া অভিযোগ, আমার নিজের টাকাই আটকা পড়ে আছে।’ শত্রুতা উদ্ধারের জন্য তার নাম বলা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। বর্তমান মেম্বার মোঃ রবিউল ইসলামকে অসংখ্যবার মোবাইল করলেও বন্ধ পাওয়া গেছে। পটুয়াখালী জেলা ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা উম্মে হাবিবা মজুমদার বলেন, এসব দালাল কারা, তাঁদের নাম ঠিকানা সুনির্দিষ্ট করে লিখিত অভিযোগ দেয়া হলে আমরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

এমইউএম/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২০:০৩:৫৮ ● ৩৮১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ