ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য দেশের মানুষের কাছে ‘ক্ষমা না চাওয়ায়’ জামায়াতে ইসলামি থেকে পদত্যাগ করেছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, যিনি যুদ্ধাপরাধে দ-িত শীর্ষ জামায়াত নেতাদের আইনজীবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন। সময়ের দাবি অনুযায়ী ‘বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের আওতায় ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে’ জামায়াতকে একটি গণতান্ত্রিক দল গড়ে তুলতে দলটির নেতাদের ব্যর্থতা নিয়ে পদত্যাগপত্রে তিনি হতাশা প্রকাশ করেছেন।
রাজ্জাকের বড় ছেলে ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী জানান, গতকাল শুক্রবার জামায়াতের আমির মকবুল আহমদকে ওই পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন তার বাবা। জামায়াতের একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, ঢাকায় তাদের আমিরের কাছে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগপত্র আসার কথা তিনিও জানতে পেরেছেন। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামি নেতাদের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বিগত ছয় বছর ধরে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন।
জ্যেষ্ঠ বদরনেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির ৫ দিন পর ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ছাড়েন জামায়াতের অন্যতম এই শীর্ষ নেতা। ব্রিটিশ নাগরিকত্বধারী এই আইনজীবী সেখান থেকেই জামায়াতের আমির মকবুল আহমদের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। আব্দুর রাজ্জাকের ব্যক্তিগত সহকারী কাউসার হামিদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক দুটি কারণ উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি থেকে পদত্যাগ করেছেন। জামায়াত ৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার জন্য জগণের কাছে ক্ষমা চায়নি এবং একবিংশ শতাব্দির বস্তবতার আলোকে এবং অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে নিজেদের সংস্কার করতে পারেনি। এসেক্সের বারকিং থেকে ঢাকায় পাঠানো পদত্যাগপত্রে রাজ্জাক জামায়াতের আমিরকে ‘পরম শ্রদ্ধেয় মকবুল ভাই’ সম্মেবধন করে লিখেছেন, একাত্তরে মুক্তিদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে জামায়াতের সকল সাফল্য ও অর্জন ম্লান করে দিয়েছে।
রাজ্জাক লিখেছেন, বিগত প্রায় দুই দশক তিনি জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা ও পাকিস্তান সমর্থনের কারণ উল্লেখ করে জাতির কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত। দলীয় ফোরামে কবে কখন কীভাবে তিনি এ বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন, তার একটি তালিকা তুলে ধরে পদত্যাগপত্রে বলা হয়েছে, সবশেষে, ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর জানুয়ারী মাসে জামায়াতের করণীয় সম্পর্কে আমার মতামত চাওয়া হয়। আমি যুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিই। অন্য কোন বিকল্প না পেয়ে বলেছিলাম, জামায়াত বিলুপ্ত করে দিন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমার তিন দশকের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। রাজ্জাক লিখেছেন, একাত্তরের ভূমিকার জন্য ‘গ্রহণযোগ্য বক্তব্য প্রদানের ব্যর্থতা এবং ক্ষমা না চাওয়ার দায়ভার’ এখন তাদেরও নিতে হচ্ছে, যারা তখন ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত ছিল না, এমনকি যাদের তখন জন্মও হয়নি। এই ক্রমাগত ব্যর্থতা জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসাবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। ফলে জামায়াত জনগণ, গণরাজনীতি এবং দেশ বিমুখ দলে পরিণত হয়েছে। জামায়াতে যোগ দেওয়ার পর দলের ভেতর থেকেই সংস্কারের চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জানিয়ে রাজ্জাক লিখেছেন, দলের কাঠামোগত সংস্কার, নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং জামায়াতের উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও কর্মসূচিতে ‘আমূল পরিবর্তন’ আনতে তার তার প্রস্তাবগুলো বিগত ৩০ বছরে ইতিবাচক সাড়া পায়নি।
পদত্যাগপত্রে রাজ্জাক বলেছেন, অতীতে অনেকবার পদত্যাগের কথা ভাবলেও তিনি নিজেকে বিরত রেখেছেন এই ভেবে যে দলের সংস্কার করা সম্ভব হলে এবং একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত জাতির কাছে ক্ষমা চাইলে তা হবে একটি ‘ঐতিহাসিক অর্জন’। কিন্তু জানুয়ারি মাসে জামায়াতের সর্বশেষ পদক্ষেপ আমাকে হতাশ করেছে। তাই পদত্যাগ করতে বাধ্য হলাম। এখন থেকে আমি নিজস্ব পেশায় আত্মনিয়োগ করতে চাই। সেই সাথে ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি সমৃদ্ধশালী ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব।
এফএন/এমআর