আমতলী (বরগুনা) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
মাত্রাতিরিক্ত সীসার প্রভাবে ভয়াবহ হুমকিতে বরগুনার আমতলী উপজেলার অবৈধ সীসা কারখানা সংলগ্ন গুলিশাখালী ইউনিয়নের আঙ্গুলকাটা গ্রামের পাঁচ হাজার মানুষ ও কয়েক হাজার গবাদী পশু। ওই গ্রামের পানিতে সীসা নেই, মাটিতে প্রয়োজনের তুলনায় ১৩৮ গুন ও খড়ে ২ হাজার ৫’শ ৫৬ গুন বেশী সীসার উপস্থিতি পেয়েছে ঢাকা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। মাত্রাতিরিক্ত সীসার বিষক্রিয়ার বিগত ডিসেম্বর মাসে ওই গ্রামের ১৫ টি গরু মারা গেছে। অসুস্থ্য হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অন্তত আরো ২৫ টি গরু। দ্রুত মাত্রাতিরিক্ত সীসার বিষক্রিয়া থেকে প্রাণীকুল ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
জানাগেছে, ২০১৮ সালে বরগুনার জেলার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের আঙ্গুলকাটা গ্রামের বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের উপরে স্থানীয় প্রভাবশালী ইউপি সদস্য আবদুস ছত্তার ফকিরের ছেলে মোঃ ইয়ামিন ফকির তার সহযোগী আল আমিন ও মামুন মৃধা সরকারী নিয়ননীতির তোয়াক্কা না করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই সীসা তৈরির অবৈধ কারখানা গড়ে তুলেন। ওই কারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। শুরুতে স্থানীয় জন সাধারনের সীসা কারখানা সম্পর্কে তেমন ধারনা ছিল না। বছর খানের পরে ওই কারখানা সংলগ্ন এলাকার মানুষের মধ্যে শ^াস কষ্ট ও হাপানির লক্ষণ ধরা পড়ে। কিন্তু এলাকার মানুষ সীসার বিষক্রিয়ার প্রভাবে এ রোগের সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝতে পারেনি। গত বছর ডিসেম্বর মাসে ওই কারখানা সংলগ্ন এলাকার ১৫ টি গরু হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে মারা যায়। এরপরে টনক নড়ে উপজেলা প্রাণী সম্পদ ও কৃষি বিভাগের। গত বছর ২৮ ডিসেম্বর আমতলী উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর এ বিষয়টি মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পটুয়াখালী আঞ্চলিক কার্যালয়ে অবহিত করেন। পরে ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর ওই কার্যালয়ের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এফ এম মামুন ও উপজেলা ভেটেরোনারী সার্জন ডাঃ মোঃ আতিকুর রহমান সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে মাটি, পানি ও খড় সংগ্রহ করে ঢাকা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে প্রেরন করেন আঞ্চলিক কর্মকর্তা। ঢাকায় পরীক্ষা শেষে সীসার কারখানা সংলগ্ন এলাকার মাটি, পানি ও খড়ে মাত্রাতিরিক্ত সীসার উপস্থিতে পেয়েছেন। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বিশ^ খাদ্য সংস্থা (এফও)’র গাইড লাইন অনুসারে মাটিতে সীসার পরিমান ০.৬৫, পানিতে ১০০ এবং উদ্ভিদে ০.৩০ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু ঢাকা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের নমুনালব্দ ফলাফলে ওই সীসা কারখানার এলাকার মাটিতে সীসার পরিমান ৮৯.৫ যা প্রয়োজনের তুলনায় ১৩৮ গুন বেশী। পানিতে সীসার পরিমান নেই। পানিতে সীসা থাকার প্রয়োজন ১০০ মাইক্রোগ্রাম কিন্তু ওই পানিতে কোন সীসা নেই। আবার খড়ে থাকার প্রয়োজন ০.৩০ মাইক্রোগ্রাম সীসা কিন্তু রয়েছে ৭৬৬.৭ মাইক্রোগ্রাম। যা প্রয়োজনের তুলনায় ২ হাজার ৫’শ ৫৬ গুন বেশী। সীসা কারখানা সংলগ্ন এলাকার প্রয়োজনের তুলনায় মাটি ও খড়ে অতিমাত্রায় সীসা রয়েছে। কিন্তু পানিতে কোন সীসা নেই। যা মানব দেহ এবং প্রাণীকুলে অত্যান্ত ভয়াবহ। সীসার অতিমাত্রার বিষক্রিয়ায় গরু মারা গেছে এবং অসুস্থ্য হয়েছে এ প্রতিবেদন দিয়েছেন ঢাকা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোসফেকা সুলতানা। এদিকে গত ১৫ দিন পূর্বে কারখানা কর্তৃপক্ষ সীসা তৈরির কাজ বন্ধ করে গা-ঢাকা দিয়েছেন।
বুধবার গুলিশাখালী ইউনিয়নের আঙ্গুলকাটা কারখানা এলাকা ঘুরে দেখাগেছে, মশারি জাল দ্বারা প্রাচীর বেষ্টিত বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের উপরে কারখানাটি গড়ে উঠেছে। ওই কারখানার ভিতরে অনেকগুলে গর্ত করে চুলার মত চুল্লি করা। পরিত্যাক্ত ব্যাটারীর কোষগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কারখানা বন্ধ। কারখানা কর্তৃপক্ষের কাউকে খুজে পাওয়া যায়নি।
ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্থ রফেজ মল্লিক, জয়নাল মোল্লা, জামাল মোল্লা, মন্নাত মল্লিক, জসিম মিয়া, সিদ্দিক মোল্লা, ইউসুফ আলী প্যাদা, সাইদুল মল্লিক, ইউনুস মৃধা ও আলতাফ মল্লিক বলেন, কারখানা সংলগ্ন আমাদের ১৫ টি গুরু ধরফর করে কাপতে কাপতে হঠাৎ মারা গেছে। এখনো আরো অন্তত ২৫ টি গুরু অসুস্থ্য রয়েছে। প্রাণী চিকিৎসকরাও রোগের ধরন বুঝতে পারছে না। যারা কারখানা তৈরি করে আমাদের এমন সর্বনাশ করেছে আমরা তাদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরন দাবী করছি।
কারখানা পরিচালক মোঃ ইয়ামিন ফকির সীসার বিষক্রিয়ার গরু মারা যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি।
আমতলী প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা অভিজিৎ কুমার মোদক বলেন, অতিমাত্রায় সীসার বিষক্রিয়াই গরু মারা গেছে। তিনি আরো বলেন, সীসা কারখানা এলাকার প্রাণীকুল রক্ষায় মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়েছে। ওই এলাকার গবাদী পশুকে খড়, ঘাস ধুয়ে ও রোধে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়াতে বলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, অবৈধ সীসা কারখানার বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
আমতলী উপজেলা কৃষি অফিসার সিএম রেজাউল করিম বলেন, ওই এলাকার এ বছর তেমন আমনের ফলন হয়নি। অনেক স্থানের ধান পুড়ে গেছে। সীসার প্রাদূর্ভাবে ওই এলাকা প্রকৃত ও জীব বৈচিত্র্য হুমকিতে রয়েছে। দ্রুত এর বিরুদ্ধে কার্যকরাী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সংকর প্রসাদ অধিকারী বলেন, সীসা গলানোর সময় বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পড়ে। যা মানব দেহ ও জীব বৈচিত্র্যের উপর অত্যান্ত ক্ষতিকর। সীসার প্রভাবে মানবদেহে অ্যাজমা, শ^াসকষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মত ভয়াবহ রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, সীসা কারখানা গড়ে তোলা পরিবেশ আইনে একেবারেই নিষিদ্ধ। এগুলো স্বাস্থ্য বিরোধী। দ্রুত ওই কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে অবৈধ সীসা কারখানার বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এমএইচকে/এমআর