মেজবাহউদ্দিন মাননু, সাগরকন্যা অফিস॥
সাগরপারের জনপদ উপকূলীয় কলাপাড়ায় গত দশ বছরে কৃষি জমি কমেছে প্রায় ১৫ হাজার একর। কিন্তু ফলন কমেনি, উল্টো বেড়েছে; ৩৩ হাজার ৯৮৭ মেট্রিক টন চালের উৎপাদন। যেখানে ২০১০ সালে আমন চালের উৎপাদন ছিল ৩৮ হাজার এক শ’ ৫০ মেট্রিক টন। তখন চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ঘাটতি ছিল দুই হাজার ১৪ মেট্রিক টন। সেখানে ২০১৯ সালে ফলন হয়েছে ৭৯ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়ে ৩৩ হাজার ৯৮৭ মেট্রিক টন উৎপাদন উদ্ধৃত্ত হয়েছে। যেখানে ২০১০ সালে উফশী ধানের আবাদ হয়েছে ২০ হাজার ৩০৩ একর জমিতে। সেখানে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আবাদ হয়েছে ৬৫ হাজার ২৩২ একর জমিতে। দশ বছরে কলাপাড়ায় উফশীর আবাদ বেড়েছে ৪৪ হাজার ৯২৯ একর জমিতে। জমি কমলেও এর প্রভাব পড়েনি উৎপাদনে। কৃষকরা উদ্যমী হয়ে উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের আবাদ করা এবং প্রশিক্ষিতভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের সুফল এ জনপদে খাদ্যউৎপাদনের অগ্রগতি ধরে রেখেছেন। কৃষকের উদ্যমি উদ্যোগ আর সরকারের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা কৃষকের কাছে মূল সহায়কের কাজ করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ জনপদ পর্যটন সমৃদ্ধ কলাপাড়ায় পায়রা বন্দর, একাধিক বিদ্যুতকেন্দ্র, নৌঘাটি নির্মান, বিভিন্ন পুনর্বাসন প্রকল্প, ফোরলেন, সিক্সলেন সড়ক, বেসরকারি উদ্যোক্তাসহ কুয়াকাটা পর্যটন এলাকার বিস্ময়কর উন্নয়ন ছাড়াও মানুষের অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণে গত ১০ বছরে প্রায় ১৫ হাজার একর কৃষি জমি কমেছে। কিন্তু কৃষি উৎপাদন কমেনি। বরং চাহিদার চেয়ে প্রায় দেড়গুন উদ্ধৃত উৎপাদনের এই জনপদে ধানসহ কৃষি উৎপাদন আরও বাড়ছে। উচ্চফলনশীল জাতের ধান, শাকসবজির উৎপাদনের পাশাপাশি এক ফসলি জমি তিন ফসলের আওতায় আনা এবং উৎপাদন খরচ কমাতে উন্নত আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যবহারে কৃষক এ সাফল্য ধরে রেখেছেন। সরকারের কৌশলী পদক্ষেপে বিশেষ প্রণোদনা এবং আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদের কারণে কৃষি জমি কমলেও উৎপাদনে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এমনকি বাড়িঘরের আঙিনা পর্যন্ত শাক-সবজির আবাদের আওতায় আনা হয়েছে।
সরেজমিনে অনুসন্ধান চালিয়ে এসব সাফল্যগাঁথা তথ্য পাওয়া গেছে। বিশেষ করে কৃষি উৎপাদনে বৈপ্লবিক ধারা বইছে। হাজার হাজার কৃষককে বিনামূল্যে ধান, শাক-সবজি, রবিশস্যের বীজ, সার প্রদান করা হয়েছে। ভর্তুকিমূল্যে আধুনিক চাষাবাদের যন্ত্রপাতি, রোপন, কাটা, মাড়াইসহ বিভিন্ন কৃষিকাজের উপকরণ সরবরাহ করায় কৃষক বাড়তি উৎপাদনের এই সাফল্য ধরে রেখেছে। কমেছে উৎপাদন খরচ। যদিও এবছর ঘুর্ণিঝড় আমফানের প্রভাবে কলাপাড়ায় আমন ধানের ফলন কিছুটা কম হয়েছে। কিন্তু ধানের দাম আশাতীত পাওয়ায় কৃষকরা স্বস্তিতে রয়েছেন। ওই উৎসাহে এখন কৃষকরা কোমর বেধে নেমেছেন বেরোর আবাদে। যেখানে গেল বছর বোরোর আবাদ হয়েছে দুই হাজার চার শ’ একর জমিতে। সেখানে এবছর ছয়গুন বেশি, ১২ হাজার ৩৫০ একর জমিতে বোরোর আবাদ হচ্ছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান এ তথ্য দিয়ে জানালেন, বেরোর ফলন বেশি হয়। গড়ে একরে দুই দশমিক ২২ মেট্রিকটন ধানের ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে কলাপাড়ায় এ বছর প্রায় ২৮ হাজার মেট্রিকটন বোরোর ফলন পাওয়ার উজ্জল সম্ভাবনার কথা জানালেন এই কৃষিকর্মকর্তা। এমনকি কৃষি শ্রমিক সঙ্কট এবং উৎপাদন খরচ কমাতে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে বেরোর আবাদ শুরু করেছেন। চম্পাপুর ইউনিয়নের মাছুয়াখালী গ্রামের ৪৮ জন চাষীর সমন্বয়ে ৫০ একর জমিতে এই উন্নত পদ্ধতির চাষাবাদ শুরু করা হয়েছে। সোমবার দুুপুরে গিয়ে দেখা গেল, আধুনিক রাইস ট্রান্স প্লান্টার মেশিনে বোরোর চারা রোপন করছিলেন কৃষক মলয় সিমলাই। উপসহকারী কৃষিকর্মকর্তা দাড়িয়ে তদারকি করছিলেন। কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানান, রবি কৃষি প্রণোদনা ২০২০-২১ কর্মসূচির আওতায় সমলয় চাষাবাদের ব্লক প্রদর্শনীর এই ধানের চারা রোপনের কাজ শুরু হলো। দুই ফুট বাই এক ফুট ট্রের উপরে ঝুরঝুরা মাটির সঙ্গে জৈব সারের মিশ্রন দিয়ে লাইন করে বীজ তলা করা হয়েছে। একেকটি ট্রেতে দুই হাজার থেকে পচিশ শ’ চারা জন্মেছে। এক ট্রে চারায় প্রায় দুই শতক জমি রোপন করা যাচ্ছে। মেশিনের মাধ্যমে রোপনের কাজ চলছে। ফসল যেন নষ্ট না হয় এ জন্য সমন্বিতভাবে একই জমিতে একসাথে রোপন, বালাইনাশক প্রয়োগ, কাটা ও মাড়াই করতে পারবে কৃষকরা। পোকার সংক্রমন থাকছেনা। কাচাপাকা থাকছেনা ধান। ক্ষতির মাত্রা কমবে। আর কৃষিশ্রমিকসহ কামলা সঙ্কটে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে উৎপাদনের বিকল্প নেই বললেন তিনি। জানা গেল ৪৮ জন চাষীর মধ্যে ৩২ জন পুরুষ ও ১৬ জন কৃষাণী রয়েছেন। ৫০ একর জমিতে হাইব্রিড ইস্পাহানি-২ জাতের বীজধান, সারসহ বীজতলা করতে ট্রে পর্যন্ত প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হয়েছে। এমনকি রোপন করার মেশিনটির ৭০ ভাগ টাকা সরকারিভাবে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। বাকি ৩০ ভাগ অর্থায়ন কৃষকরা করেছেন। কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যানুসারে এই ধানের ফলনও খুব বেশি পাওয়া যাবে। আশা করা হচ্ছে হেক্টরে কমপক্ষে সাড়ে ছয় টন ফলন পাওয়ার। এ চাষাবাদ পদ্ধতির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের জন্য কৃষিবিভাগের কর্মকর্তা ছাড়াও পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী কৃষককে উৎসাহ দিতে অজোপাড়াগাঁ মাছুয়াখালী ছুটে গিয়েছেন। তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘ কৃষিবান্ধব সরকারের কৃষি উৎপাদন আরও বাড়াতে মাঠপর্যায়ে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তাইলে সরকারের মেগা প্রজেক্টসহ সকল উন্নয়ন কাজের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন আমাদের চাহিদার চেয়ে উদ্ধৃত ফলন ফলাতে পারব। কৃষির উন্নয়ন আরও এগিয়ে যাবে।’ এই ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সবসময় কৃষকের পাশে রয়েছেন। থাকবেন। ধানখালীর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, উন্নত পদ্ধতির চাষাবাদ এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের কৃষি উৎপাদনে আগ্রহ সৃষ্টি করতে তার মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা এসএম রাকিবুল আহসান, ইউএনও আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খামারবাড়ি, পটুয়াখালীর উপ-পরিচালক হৃদয়েশ^র দত্ত।
কৃষি অফিস কলাপাড়ার দেয়া তথ্যমতে, ২০০৮ সালে কলাপাড়ায় উফশি জাতের ধানের আবাদ হয় মাত্র ২০ হাজার ৩০৩ একর জমিতে। ফলন হয় ২৮ হাজার ৭৭০ মেট্রিক টন। ২০১৯ সালে উফশি জাতের ধানের আবাদ হয়েছে ৬৫ হাজার ২৩২ একর জমিতে। আর ফলন হয়েছে ৭৯ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন চাল। যেখানে বর্তমানে চাহিদা রয়েছে ৪৫ হাজার ৪৯৩ মেট্রিক টন চাল। অথচ উল্টোচিত্র চাষাবাদের জমির হিসেবে। ২০০৮ সালে স্থানীয় জাতসহ মোট আবাদি কৃষি জমি ছিল ৯৫ হাজার ৩৪২ একর। আর এখন ২০১৮ সালে কমে চাষের জমির পরিমাণ হয়েছে ৮৫ হাজার ২১৫ একর। সরকারী হিসেবে কলাপাড়ায় চাষের জমি কমেছে ১০ হাজার ২১৭ একর। যেখানে ফলন কমার কথা ৪০ হাজার মেট্রিক টন চাল। উল্টো ফলন বেড়েছে অন্তত ৩৪ হাজার মেট্রিক টন। সরকারি হিসেব এটি হলেও বেসরকারি হিসেবে কৃষি জমি কমেছে অন্তত ১৫ হাজার একর। কলাপাড়ায় বর্তমানে সরকারি হিসেবে দুই লাখ ৪৯ হাজার ৩৮৮ জন মানুষের জন্য খাদ্য চাহিদা ৪৫ হাজার ৪৯৩ মেট্রিক টন চাল। যেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৭৯ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন চাল। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানান, কৃষি উৎপাদনের অগ্রযাত্রা ধওে রাখতে ফি বছরের মতো এ বছরও প্রায় দেড় হাজার কৃষককে বীজ ধান ও সার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। তবে অনেক কৃষকের অভিযোগ বোরোর আবাদ করছেন না এমন কৃষককে বীজ-সার দেয়া হয়েছে। অনেকে বীজধান বিক্রি করে দিয়েছেন। বহু প্রকৃত কৃষক প্রণোদনা পায়নি। তারপরও ধার-দেনা করে কৃষকরা বীজ-সার কিনে কোমর বেধে বোরোর আবাদ করছেন। সকল কৃষকের দাবি একটাই স্লুইস সংযুক্ত খালের অগ্রভাগে লোনা পানির প্রবেশ ঠেকানোর জন্য সরকারি উদ্যোগে বাঁধ দিতে হবে।
এমইউএম/এমআর