ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
পর পর তিনটি নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশ নাজুক অবস্থানে পড়েছে বলে অনেকের মত। তবে নতুন কর্মকৌশল ঠিক করা নিয়ে সংকটের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে দলটি। দল পরিচালনার পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিএনপিতে। এমন অবস্থায়ও করণীয় নির্ধারণ করা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে দলের নেতাদের মধ্যে। বিশেষ করে, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কিভাবে নতুন কর্মকৌশল তৈরি করা হবে তা নিয়ে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। বরং ঐক্যবদ্ধ থাকার বদলে দলটির উপরিকাঠামোতে কিছুটা সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের স্কাইপের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নেওয়ার মধ্য দিয়ে দলে তারেকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়। দলীয় সূত্র মতে, পছন্দের কিছু প্রার্থীকেও তিনি মনোনয়ন দেন, যাঁদের মধ্যে ‘হাওয়া ভবনে’র ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কয়েকজন ছিলেন। ওই ঘটনায় প্রথমবারের মতো অসন্তুষ্ট হন সিনিয়র নেতারা। এরপর নির্বাচনের আগে জামায়াতকে ধানের শীষ মার্কা দেওয়া ঠিক হবে না বলে একমত হয়েছিল বিএনপির স্থায়ী কমিটি। কিন্তু দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্তও বদলে গিয়েছিল তারেকের ইঙ্গিতে।
বিএনপির ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে, তারেকের ওই সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ ক্ষুব্ধ হয়, যারা বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের গাঁটছড়া পছন্দ করে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে থাকায় আপাতত জাতীয় কাউন্সিল করা সম্ভব হচ্ছে না।
জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমাদের কিছু না কিছু কৌশল ও রাজনীতি করতে হবে।’ কর্মকৌশল নিয়েও চিন্তাভাবনা হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। বিএনপির প্রবীণ এই নেতা বলেন, ‘রাজনীতি তো করতে হবে!’ যথাসময়ে বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অবশ্য জানান, পরবর্তী করণীয় নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে তিনি এখনো কোনো চিন্তাভাবনা করেননি। আবার দলের কারো সঙ্গেও এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি তাঁর। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক; টিকে তো থাকতে হবে! আর টিকে থাকতে গেলে রাজনীতি ছাড়া আর তো কোনো উপায় নেই। একটু সময় লাগবে, এই আর কি!’ বিএনপি প্রতিষ্ঠার ৪০ বছরের মধ্যে প্রায় ৩৬ বছর ধরে দলটির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ায় গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি কারাগারে আছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হাল ধরলেও গত এক বছরে দলের রাজনৈতিক অর্জন নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের দাবি উঠেছে দলের ভেতর থেকেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৌশলগত কারণে, বিশেষ করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে শিগগির কাউন্সিল করা সম্ভব হচ্ছে না বলে নিশ্চিত করেছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা।
বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘এত তাড়াহুড়া কিসের? ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ এক বছর অপেক্ষা করেছিল, কিছু করেনি। কিন্তু এবার বিএনপি তো পরাজিত হয়নি, কারসাজি এবং জোর করে পরাজিত করা হয়েছে। সুতরাং জনগণ সঙ্গে থাকলে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে না।’ অবশ্য বিএনপির বড় একটি অংশের পাশাপাশি দলের বেশির ভাগ শুভানুধ্যায়ীও মনে করেন, নেতৃত্বের সংকটের কারণেই বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হচ্ছে। শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, ঘুরে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই শূন্যপদ খুব শিগগির পূরণ করতে হবে। তিনি বলেন, বিএনপির এখন যে চুপচাপ নীতি তা ভেঙে সারা দেশে কারাগারে থাকা দলের নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে সক্রিয় মাত্র আটজন। শূন্যপদই আছে পাঁচটি। অথচ ওই পদগুলো পূরণ করার কোনো উদ্যোগও নেই। খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা ছাড়াও ওই কমিটির তিনজন সদস্য অসুস্থ, যাঁরা মাঝে-মধ্যে বৈঠকে যোগ দিলেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না। অন্যদিকে বিদেশে আছেন তারেক রহমান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ। সূত্র মতে, দল পরিচালনায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পরামর্শ নেওয়া হলেও নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিএনপি চলছিল যৌথ নেতৃত্বে। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বৈঠক করে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু সম্প্রতি কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারেক রহমানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া দলের মধ্যম সারির কিছু নেতার সঙ্গে ইদানীং স্কাইপে কথা বলছেন তিনি। ওই সব ঘটনায় বেশির ভাগ সিনিয়র নেতার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছে। পাশাপাশি তারেক যাঁদের কাছে টানছেন তাঁরা দলের মধ্যে নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবতে শুরু করেছেন। সার্বিকভাবে এতে বিএনপিতে বিভেদ তৈরি হচ্ছে, যা নির্বাচনের আগে ছিল না।
বিএনপির শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, বিএনপিকে সামনের দিকে চলতে হলে প্রথমত সব শূন্যপদ পূরণ করতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, সর্বক্ষেত্রে যৌথ নেতৃত্ব চালু করতে হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এই বিশিষ্ট নাগরিক বলেন, ‘তারেক দূর থেকে উপদেশ দিলে ক্ষতি নেই। কিন্তু তার খবরদারি বেশি স্পষ্ট হলে বিএনপি কতদূর এগোবে বলা মুশকিল।’ বিএনপির করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দল গুছিয়ে তাদের রাজপথে নামা উচিত। নির্বাচনের পর তাদের কিছু না কিছু প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। প্রতিদিন তাদের ট্রাকে করে মিছিল করা উচিত। কিন্তু তারা তো সুখে আছে বলে মনে হয়।’
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য গত ২ জানুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে প্রবীণ দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে তাঁদের না ডাকায়। কয়েকটি বৈঠকে তাঁদের ডাকা হয়নিÑএমন অভিযোগ করে তাঁরা বলেছিলেন, ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে এরপর আর তাঁরা যাবেন না। প্রথমে খন্দকার মোশাররফ এবং পরে মওদুদ আহমদ ওই কথা বলেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছিলেন, তিনিও বৈঠকে আর যাবেন না। পরে ৫ জানুয়ারি ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক হয় বিএনপির প্রতিনিধি ছাড়াই। বিষয়টি নিয়ে প্রথমবারের মতো টানাপড়েন তৈরি হয় ফ্রন্টে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছাড়াও বিএনপির বড় একটি অংশ মনে করে, ঘটনাটি ওইভাবে সামাল না দিয়ে তারেক স্থায়ী কমিটির হাতে ছেড়ে দিতে পারতেন। আবার সিনিয়র দুই নেতাকেও তিনি অনুরোধ করে স্টিয়ারিং কমিটিতে আবার পাঠাতে পারতেন। কিন্তু দলের প্রবীণ দুই নেতার স্থলে নতুন প্রতিনিধি নিয়োগ করায় একদিকে দলের মধ্যে তৈরি হয়েছে বিব্রতকর অবস্থা, অন্যদিকে দলের মধ্যে তারেকের কর্তৃত্ব ফলানোর বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বেশি ‘গাঁটছড়া’ বেঁধে অন্য শরিকদের যথাযথ মূল্যায়ন না করার অভিযোগ আছে ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোর। ফলে ঘুরে দাঁড়াতে হলে বিএনপিকে এখন এই দুই জোটের মধ্যে সমন্বয়ের কৌশল বের করতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২ জানুয়ারির বৈঠকে তারেক রহমান স্কাইপে থাকা অবস্থায় তাঁর সামনেই তিন নেতার অবস্থান দৃশ্যমান হয়েছিল। কিন্তু তারেক রহমান ওই ঘটনা নিয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আর আলোচনা না করে মৌখিক নির্দেশে ড. আবদুল মঈন খান ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকের জন্য মনোনীত করেন। এতেও দলের মধ্যে কিছুটা ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হয়। যদিও সর্বশেষ বৈঠকে ড. মোশাররফ ও মওদুদকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
এফএন/এমআর