সরকারি কর্মচারীদের বিভাগীয় মামলা তদন্তে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ

প্রথম পাতা » বিশেষ প্রতিবেদন » সরকারি কর্মচারীদের বিভাগীয় মামলা তদন্তে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ
সোমবার ● ১১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯


সরকারি কর্মচারীদের বিভাগীয় মামলা তদন্তে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ

ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥

সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বিভাগীয় মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা করে থাকেন। ফলে নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার কোনোটিই সম্ভব হয় না। এমন অবস্থায় নিরপেক্ষ তদন্তে একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে ওই কর্তৃপক্ষ গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে। শিগগিরই তার কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমান সরকার প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে শুদ্ধি অভিযানের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বড় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো পরিদর্শন শুরু করেছেন। পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিপূর্বে গতবছর সচিব সভার আলোচনায়ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত ও বিচারের আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়টি স্থান পেয়েছিল। আর সেটি গঠনে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশও দেয়া হয়। কিন্তু পরে অজানা কারণে তা থেমে যায়। কিন্তু সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণায় ওই বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে।
সূত্র জানায়, প্রতিবছরই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার বিভাগীয় মামলা হয়। কিন্তু ওসব মামলার খুব কমই যথাসময়ে নিষ্পত্তি হয়। নিষ্পত্তি হলেও তাতে গলদ থেকে যায়। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা একই বিভাগের অন্য কর্মকর্তা তদন্ত করায় তা নিরপেক্ষ হয় না। বেশিরভাগ বিভাগীয় মামলাই আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়। অথচ ওসব মামলায় কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ থাকে। প্রশাসনে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মের শত শত অভিযোগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়লেও উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বেশিরভাগই তদন্ত পর্যায়ে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদন্ত শেষে বিভাগীয় মামলা হলেও দায়সারা শুনানি শেষে সেগুলো শাস্তি ছাড়াই নিষ্পত্তি করে দিচ্ছে মন্ত্রণালয়। আবার অনেক অভিযোগ আমলেই নিচ্ছে না সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়। তাতে মাঠপর্যায়সহ সব ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা অপকর্মে উৎসাহ পাচ্ছে। আর কর্মকর্তাদের অভিযোগের বিচার না হওয়ায় প্রশাসনে দুর্নীতি বেড়ে গেছে। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনে সীমাহীন দুর্নীতি চলছে। এসিল্যান্ড অফিস থেকে শুরু করে বিভাগীয় কমিশনার অফিস পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। টাকা ছাড়া ওসব অফিসে কোনো কাজই হয় না। সেবাপ্রার্থী সাধারণ মানুষ সেবার পরিবর্তে ভোগান্তির মুখে পড়ছে। এমনকি মাঠপর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পদস্থ কর্মকর্তাদের একটি রেট বেঁধে দিচ্ছে। প্রতি মাসে প্রতি স্টেশন থেকে কতো টাকা দিতে হবে, তারও একটি তালিকা তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে মাঠপ্রশাসনে লেজেগোবরে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, আলাদা কর্তৃপক্ষ হলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বিচার সম্পন্ন হবে। তাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতি ও অসদাচরণে নিরুৎসাহিত হবে। কারণ তাদের মধ্যে একধরনের বিচারের ভয় ঢুকবে। তখন তাদের কাছ থেকে প্রকৃত সেবা পাওয়া যাবে। সাবেক একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে কর্তৃপক্ষের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হবে। আর মামলা তদন্তে থাকবে একাধিক টিম। ওসব টিমের নেতৃত্বে থাকবেন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা। অভিযোগের ধরন অনুযায়ী টিমগুলো কাজ করবে। মূলত অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদেরই ওসব পদে নিয়োগ দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে সাবেক আমলাদের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। তাছাড়া নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে বিচারের জন্য একটি বোর্ড গঠন করা হবে। সাবেক অতিরিক্ত সচিব বা সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বোর্ডের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে। ওই বোর্ড অপরাধের তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তি ঘোষণা করবে। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী শাস্তির বিপরীতে আপিল করতে চাইলে কর্তৃপক্ষ প্রধানের কাছে আপিল করতে পারবেন। তবে ওই বোর্ড গঠনের আগে এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়ন করবে সরকার।
এদিকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আসে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অভিযোগ এলেও তা তদন্তের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চলে আসে। আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওই ধরনের কাজ করে শৃঙ্খলা বিভাগ। কিন্তু শৃঙ্খলা বিভাগে জনবল সংকট ও কর্মকর্তাদের কিছুটা অনীহার কারণে অভিযোগগুলো মাসের পর মাস পড়ে থাকছে। মূলত এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ তদন্ত ও বিচারে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা ভাবছে সরকার।
অন্যদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট থাকার অভিযোগ রয়েছে। মাঠপ্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে ওই সিন্ডিকেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে তার অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত করে। পরে ওই কর্মকর্তা সিন্ডিকেটের সঙ্গে দেনদরবার করে অভিযোগের কপি সরিয়ে ফেলে। এভাবে গত এক বছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রায় হাজারখানেক অভিযোগ জমা পড়েছে। তার মধ্যে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগের পাল্লা ভারি। তাদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যহারের অভিযোগই বেশি পাওয়া গেছে। কিন্তু এসময়ে ওসব অভিযোগের উল্লেখযোগ্য কোনো বিচার হয়নি। এমনকি কোনো কোনো অভিযোগের তদন্তে দেয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তদন্ত দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। আবার তদন্ত রিপোর্ট জমা দিলেও নামমাত্র বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে।  অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমনও ঘটনা ঘটেছে- কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা শাখায় তা সেভাবেই রয়ে গেছে। মূলত কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সরকারি কর্মচারী শৃৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা ১৯৮৫ অনুযায়ী বিচার হওয়ার কথা। বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা তদন্তে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হলে বিভাগীয় মামলা হবে। আর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অভিযোগ প্রমাণ হলে শুনানির ব্যবস্থা করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে রায় দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে তদন্ত সন্তোষজনক না হলে পুনরায় তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করারও বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণ হলেও সর্বোচ্চ লঘুদ- দেয়া হচ্ছে। ফলে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হচ্ছে। তাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাঘাত ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমেদ জানান, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গেই তদন্ত করা হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে তো আর বিচার করা যায় না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত হয়, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসে তার বেশিরভাগেরই সত্যতা মেলে না। তবে কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ এলে তার ব্যবস্থা নেয়া হয়।

এফএন/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ১০:২২:৫৭ ● ৮২৩ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ