কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥
রবিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিশ^ নদী দিবস। ২০১০ সাল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের রবিবার এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এরই মধ্যে নদী-খাল দখল-ভরাট ও দূষনের তীব্রতা বেড়েই চলছে। আশার কথা, মহামান্য হাইকোর্ট পহেলা জুলাই নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের পুর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। রায়ে আদালত বলেন, মানুষের জীবন-জীবিকা নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবজাতি টিকে থাকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। নাব্যসঙ্কট ও বেদখলের হাত থেকে নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সঙ্কটে পড়তে বাধ্য। নদী রক্ষায় দেশ-বিদেশে সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কর্মকান্ডসহ সামাজিক আন্দোলন চলে আসছে। এখন সবারই ভাবনা- পরিবেশের জন্য নদী রক্ষা করতে হবে।
সারা দেশের মতো কলাপাড়ায় সাগরসহ নদী রক্ষায় কয়েকটি সামাজিক সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে কলাপাড়ার প্রধান নদী ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদী সবচেয়ে গুরুত্ববহন করে আসছে। এক সময়ের খর¯্রােতা আন্ধার মানিক নদী তার সর্বস্ব হারাতে বসেছে। নদীটির দুই পাড়ে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। মাঝখানে বহু পয়েন্টে জেগে উঠেছে চর। ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদী এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। যেন যৌবন হারিয়ে ফেলছে। নদীর পানির প্রবাহ কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে।
জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন জনিত কারণ ছাড়াও দখল-দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় কলাপাড়ার প্রধান এই নদীটি এখন নৌ-চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দেশ স্বাধীনের পরেও আন্ধার মানিকের বুকে দোতলা লঞ্চ-স্টীমার চলাচল করত। এখনও লঞ্চ চলাচল করছে। তবে পুরো নদীটি লঞ্চ চলাচলের উপযোগী নেই। নদীটি তার চিরচেনা বৈশিষ্ট হারিয়ে ফেলছে। দুই পাড় থেকে পলির চরে পরিধি গেছে কমে।
‘আন্ধার মানিক’ কলাপাড়া শহর থেকে গিয়ে মিশেছে সাগরে। সেখানকার মোহনায় বালুর চর পড়ায় পানি প্রবাহের পথ অপ্রশস্ত হয়ে গেছে। জেলেসহ সাধারণ মানুষ মূলতঃ এই প্রতিবন্ধকতাকে ভরাটের প্রধান কারন হিসাবে মনে করছেন। এক যুগ আগেও সাগরের এই মোহনা থেকে প্রবল জোয়ারের প্রবাহ রামনাবাদ চ্যানেলে গড়াত। নদীটির দীর্ঘ এলাকার দুই দিকে ছিল অসংখ্য শাখা নদী, ছোট-বড় খাল। এছাড়া শত শত স্লুইস খালও ছিল আন্ধার মানিক নদীর দুই পাড়ে। জোয়ার-ভাটার সময় প্রবলবেগে শাখা নদী কিংবা খালে পূর্ণ জোয়ারের প্রবাহ বইত।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আন্ধার মানিকের সঙ্গে সংযুক্ত কচুপাত্রা নদীতে প্রবেশদ্বারে বাঁধ দেয়া হয়েছে। এরফলে অন্তত ২৫ কিলোমিটার এলাকা পানির প্রবাহপথ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। একইভাবে আরপাঙ্গাশিয়া দোন নদীটি ভরাট হয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা চাষের জমি হয়ে গেছে। এই নদীর সঙ্গে আন্ধার মানিক নদীতে এখনও সংযোগ রয়েছে। কিন্তু জোয়ারের পানি শুধু ফুলে-ঁেফপে উঠছে। ¯্রােত বয় না। একই দৃশ্য আন্ধার মানিকের টিয়াখালী অংশের লোন্দা নদীর। মাঝখানের বিভিন্ন অভ্যন্তরীন ছোট-বড় ভাড়ানির অন্তত ১২টি খাল ভরাট হয়ে গেছে। যেসব দিয়ে ভাটার সময় সবধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকে। এসব সমস্যা ছাড়াও বেড়িবাঁধের অভ্যন্তরের স্লুইস খাল ভরাট ও দখল হওয়ায় পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। আর এসব কারণে পলি পড়ে নদীর তলদেশ থেকে কিনার পর্যন্ত দ্রুত ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়া কলাপাড়া পৌর শহরের শেখ কামাল সেতুর নিচ থেকে বালিয়াতলী খেয়াঘাট পর্যন্ত নদী তীর দখল করে স্থাপনার পাশাপাশি ইটভাঁটি গড়ে উঠেছে। নদীটির নীলগঞ্জ এলাকায় ভরাট তীরসহ খাস ভূমি দখল করে বহু ইটভাঁটি নিমর্মাণ হয়েছে। কলাপাড়া শহরবাসীর সকল পারিবারিক বর্জ্য এ নদীতে ফেলা হয়। খোদ পৌরসভা কর্তৃপক্ষর বর্জ্য ফেলছে।
এখানখার প্রবীণ কৃষকসহ বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ষাটের দশকের প্রথম দিকে লোনা পানির গ্রাস থেকে আবাদি জমি রক্ষার স্বার্থে কৃষিকাজ করতে আন্ধার মানিকসহ বিভিন্ন নদীর দুই পাড় দিয়ে অসংখ্য বেড়িবাঁধ করা হয়। মূলত তখন থেকেই খর¯্রােতা আন্ধার মানিক নদীর দুই পাড় ভরাট প্রক্রিয়া শুরু হয়। পাশাপাশি সংযোগ নদী, অভ্যন্তরীণ খাল ভরাট ও দখলের কারনে নদীর ¯্রােত থমকে যায়। এসব কারনেই দ্রুত পলি পড়ে ভরাট হতে থাকে আন্ধার মানিক নদী। আর এই প্রক্রিয়া বর্তমানে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এখন প্রতি বছর অন্তত পাঁচ থেকে দশ ফুট কমে যাচ্ছে নদীর প্রস্থ। এছাড়া নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গভীরতাও আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। এখানকার সচেতন প্রবীন নাগরিকগণ মনে করেন, সাগরপারের এই জনপদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্ধারমানিক নদী রক্ষায় এখনই সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। নইলে মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে আন্ধার মানিক নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় অন্তত সাতটি স্লুইস সংযুক্ত খাল ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। আর এর বিরুপ প্রভাব পড়ছে কৃষিকাজের ক্ষেত্রে। এমন নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত থাকলে কলাপাড়ার নীলগঞ্জ, চাকামইয়া, তালতলীর চাউলাপাড়া, কড়ইবাড়িয়া ইউনিয়নের প্রায় কুড়ি হাজার একর জমি চাষাবাদে ভয়াবহ সমস্যার আশঙ্কা করছেন কৃষক।
কলাপাড়ার প্রবীণ সাংবাদিক কলাপাড়া প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শামসুল আলম বলেন, দেশ স্বাধীনের পরেও আন্ধার মানিক প্রচন্ড খর¯্রােতা ছিল। এর সঙ্গে আরপাঙ্গাশিয়া নদী ছিল আমতলীর সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন। আরপাঙ্গাশিয়া নদী দিয়ে তখন স্টীমার চলাচল করত। আর এখন আরপাঙ্গাশিয়া ভরাট হয়ে গেছে। আর ভরাট অংশে চাষাবাদ হচ্ছে। তাই তিনিও আগে ভাগেই আন্ধার মানিক নদী যে অংশ ভরাট হয়ে গেছে তা কেউ যেন দখল করে স্থাপনা তুলতে না পারে এজন্য ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন। উপজেলা মৎস কর্মকর্তা জানান, আন্ধার মানিক নদীটি ইলিশের অভয়াশ্রম করা হয়েছে। তাই এ নদীর গুরুত্ব আলাদা। এলাকার সবশ্রেণির মানুষের দাবি কলাপাড়া একটি পর্যটন সমৃদ্ধ উপজেলা। আর এ উপজেলায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম আন্ধার মানিক নদী। এটি রক্ষা করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ভরাট অংশ খনন করা প্রয়োজন। জেগে ওঠা চরকে জমি হিসাবে কেউ যেন দখল করতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা নেয়া। এছাড়া পরিবেশ রক্ষায় আন্ধার মানিকের জেগে ওঠা চরায় বনাঞ্চল সৃষ্টি করাও প্রয়োজন বলে মনে করছেন পরিবশে সচেতনরা।
এমইউএম/এমআর