আমতলী (বরগুনা) সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
“মোরা এক সোমায় গাঙ্গের ধারে বইয়া ওই পাড়ের মানুর সাতে কতা কইতাম। এ্যাহোন হেই গাঙ্গ ভাইঙ্গ্যা বড় অইয়্যা গ্যাছে। এই গাঙ্গে মোগো ঘর-বাড়ী জায়গা জমি ভাইঙ্গ্যা গ্যাছে। মোরা জায়গা জমি খুঅ্যাইয়্যা গরিব অইয়্যা গেছি। মোগো ১৫ একর জমি গাঙ্গে ভাইঙ্গ্যা গ্যাছে”। এ্যাহান গুড়াগাড়া লইয়্যা কোন মতে বাইচ্চা আছি।
আক্ষেপ কন্ঠে এ কথা বলেছেন, বরগুনার তালতলী উপজেলার মৌপাড়া গ্রামের ৯০ বছর বয়সি লতিফ তালুকদার। থামছে না পায়রা নদীর ভাঙ্গন। নদীর ভাঙ্গনে প্রতিদিনই আয়তনে ছোট হচ্ছে আমতলী ও তালতলী উপজেলা। বিগত এক মাসে ভয়াল পায়রা ভাঙ্গনে আমতলী-তালতলী উপজেলার অন্তত অর্ধশত একর ফসলি জমি ও শতাধিক ঘর-বাড়ী নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। ফসলি জমি ও ঘর বাড়ী হারিয়ে পথে বসেছেন হাজারো পরিবার। এছাড়াও হুমকির মুখে পড়েছে তালতলী আইসোটেক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্প এলাকা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা আমতলী-তালতলী উপজেলাকে পায়রা নদীর ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষায় দ্রুত ব্লক নির্মাণের দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
জানাগেছে, প্রমত্তা বুড়িশ্বর বা পায়রা নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৯০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ছিল ১২০০ মিটার। বর্তমানে নদীটি ভেঙ্গে গড় প্রস্থ হয়েছে ৩৫০০ মিটার। নদী ভেঙ্গে পূর্বের চেয়ে প্রস্থ তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ভয়াল পায়রা নদী উত্তাল থাকে। জোয়ার ও ভাটার ¯্রােতে নদী ভেঙ্গে আকারে বড় হচ্ছে। আয়তনে ছোট হচ্ছে আমতলী-তালতলী উপজেলা। গত ২৫ বছরে পায়রা নদীর পাড়ের হাজার হাজার একর ফসলি জমি ও হাজার হাজার পরিবারের ঘর-বাড়ী নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। ভিটা মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ। গত এক মাসে আমতলী ও তালতলীর ৪৫ কিলোমিটার পায়রা নদীর চাওড়া ইউনিয়নের পশ্চিম ঘটখালী, পৌর শহরের বৈঠাকাটা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, লোচা, আড়পাঙ্গাশিয়ার পশুরবুনিয়া, বালিয়াতলী,পচাঁকোড়ালিয়া স্লুইজ, মৌপাড়া, গাবতলী, নকড়ী, তেতুঁলবাড়িয়া ও জয়ালভাঙ্গার অর্ধশত একর ফসলি জমি ও শতাধিক ঘর-বাড়ী নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। প্রতিদিনই এ সকল স্থান দিয়ে প্রবল ¯্রােতের চাপে নদীর পাড় ভাঙ্গছে। এছাড়াও হুমকির মুখে পড়েছে তালতলী আইসোটেক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্প এলাকা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা আমতলী-তালতলী উপজেলাকে পায়রার কড়াল গ্রাস থেকে রক্ষায় এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ব্লক নির্মাণের দাবী জানিয়েছেন।
বুধবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, আমতলী উপজেলার চাওড়া ইউনিয়নের পশ্চিম ঘটখালীর ১০০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে নদীর পাড়ে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ শতাধিক ঘর-বাড়ী নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। আমতলী পৌর শহরের বৈঠাকাটা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, পুরাতন লঞ্চঘাট ও ফেরীঘাট পর্যন্ত ৪০০০ মিটার, পশুরবুনিয়া ৩০০০ মিটার, বালিয়াতলী ২০০০ মিটার, পচাঁকোড়ালিয়া ১০০০ মিটার, মৌপাড়া ২০০০ মিটার, গাবতলী ২০০০ মিটার, তেতুঁলবাড়িয়া ১০০০ মিটার ও জয়ালভাঙ্গা ১০০০ মিটার পায়রা নদীর পাড় ভেঙ্গে ফসলি জমি ও ঘর-বাড়ী নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। ওই স্থানগুলোতে বসবাসরত পরিবারগুলো ভিটে মাটি ছেড়ে খুপরি ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক পরিবার ভিটে মাটি হারিয়ে জন্মভুমি ছেড়ে কাজের সন্ধানে পরিবার পরিজন নিয়ে রাজধানী শহর ঢাকা ও চট্টগ্রাম, খুলনা, রবিশালসহ বড় বড় শহরে চলে গেছেন। আইসোটেক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্প এলাকা পায়রার ভাঙ্গনের মুখে পরেছে।
তালতলী উপজেলার মৌপাড়া গ্রামের মোঃ শানু তালুকদার ও গাবতলী গ্রামের মোশাররফ হোসেন সেন্টু ডাকুয়া বলেন, গত এক সপ্তাহে অন্তত চার একর জমি নদীতে ভেঙ্গে গেছে। সন্ধ্যায় জমি দেখে যাই, সকালে এসে দেখি ওই জমি নাই। পায়রা নদীর হাত থেকে বসত ঘর ও জমি রক্ষায় দ্রুত ব্লক নির্মাণের দাবী জানাই।
আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের বালিয়াতলী গ্রামের সাইদুর রহমান বলেন, পশুরবুনিয়া, বালিয়াতলীর প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ফসলি জমি ও ঘরবাড়ী পায়রা নদীতে ভেঙ্গে বিলিন হয়ে গেছে। দ্রুত এ এলাকায় ব্লক নির্মাণ করে নদীর ভাঙ্গন রোধ করা না হলে এখানে বসবাসরত কয়েক শত পরিবার ভিটা মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে।
আমতলীর চাওড়া ইউনিয়নের পশ্চিম ঘটখালী গ্রামের রেজাউল করিম পান্না বলেন, পায়রার ভাঙ্গনে বিদ্যালয়, ক্লিনিক, মাদ্রাসা ও মসজিদসহ শতাধিক ঘর-বাড়ী নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। বাবার ভিটে মাটি নদীতে বিলিন হয়ে যাওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে আমতলী পৌর শহরে বসবাস করছি।
তালতলীর তেতুঁলবাড়িয়া গ্রামের আলমগীর হাওলাদার বলেন, তেতুলবাড়িয়া ও জয়ালভাঙ্গায় পায়রার ভাঙ্গন থামছেই না। প্রতিদিন ভেঙ্গে ফসলি জমি ও ঘর-বাড়ী নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাচ্ছে।
একই গ্রামের জসিম মিয়া জানান, বিকেলে জমিতে ফসল রোপন করে এসেছি। পরের দিন সকালে ওই জমি আর খুঁজে পাচ্ছি না। দ্রুত ব্লক নির্মাণ করে পায়রার ভাঙ্গন রোধের দাবী জানাই।
তালতলী উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক ছোটবগী ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ তৈফিকুজ্জামান তনু বলেন, পায়রা নদী শাসন ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে তালতলীর নিশানবাড়িয়া ও সোনাকাটা ইউনিয়ন অচিরেই নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়া সম্ভবনা রয়েছে। এতে পায়রা নদী সংলগ্ন আইসোটেক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ এলাকায় সরকারের উন্নয়নের রোল মডেল ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
আমতলী উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান বলেন, পায়রা নদীর ভাঙ্গনের হাত থেকে ফসলি জমি ও ঘর-বাড়ী রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা নেয়া দরকার। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে আরো ভয়াবহ ভাঙ্গনের মুখে পরবে আমতলী উপজেলা ও পৌর শহর।
আমতলী উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ¦ গোলাম ছরোয়ার ফোরকান বলেন, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা আমতলী-তালতলী উপজেলাকে ভয়াল পায়রা নদীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষায় তার সুদৃষ্টি কামনা করছি। তিনি আরো বলেন, পায়রার ভাঙ্গনে আমতলী-তালতলী ক্রমশ ছোট হচ্ছে আসছে। পায়রার ভাঙ্গন রোধে দ্রুত ব্লক নির্মাণের দাবী জানাই।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কায়সার আলম বলেন, পায়রার ভাঙ্গন রোধে পশ্চিম ঘটখালী, আমতলী পৌরসভা, পশুরবুনিয়া, বালিয়াতলী, মৌপাড়া, গাবতলী, জলায়ভাঙ্গা ও তেতুলবাড়িয়ার ৮ কিলোমিটার এলাকায় ব্লক নির্মাণের জন্য ডিপিপি করে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়েছি। প্রকল্প পাশ হলে দ্রুত কাজ শুরু করবো।
এমএইচকে/এমআর