ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার ২৪তম আসরে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো প্রায় ২শ কোটি টাকা রফতানি আদেশ পেয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, প্রতিবছরই আমাদের মেলার ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে পূর্বাচলে স্থায়ী বাণিজ্যমেলা প্রাঙ্গণেও এ ধরনের মেলা আয়োজন করা সম্ভব নয়। একইসঙ্গে আজ থেকে ১০ বছর পরে এখানে এ মেলা করা যাবে কি-না তা নিয়ে এখন থেকেই ভাবতে হবে। বিগত বছর ২৩তম আসরে ১৬৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকার রফতানি আদেশ পেয়েছে। আর এ বছর বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো প্রায় ২০০ কোটি টাকা রফতানি আদেশ পেয়েছে। সে হিসেবে এ বছর রফতানি আদেশ বেড়েছে ৩৫ কোটি টাকা।
শনিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বাণিজ্যমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। এসময় অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব এস এম রেজওয়ান হোসেন এবং রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্যসহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, বিগত ৮ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্যমেলা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের অনুরোধে সময় একদিন বাড়ায় আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এবারের মেলায় ১২ ক্যাটাগরিতে ৪২টি প্যাভিলিয়ন ও স্টলকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। টিপু মুনশি বলেন, বাণিজ্যমেলায় এবার বিক্রি ও রফতানি আদেশ ভালো হয়েছে। আমাদের মেলার চাহিদা যেভাবে বাড়ছে, এখানে মেলা করতে হিমশিম খেতে হয়। আগামীতে পূর্বাচলে ৩০ একর জায়গায় এ মেলা আয়োজন করা সম্ভব কি-না, তা এখন থেকেই ভাবতে হবে। আগামি ১০ থেকে ১৫ বছর পর মেলার চাহিদা আরো বাড়বে। কারণ পূর্বাচলে ৩০ একর জায়গা এ মেলার জন্য অপ্রতুল। তবে সেখানে সারা বছর অন্যান্য মেলা চলবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা সেখানে আয়োজন করা যাবে না। তাই এখন থেকে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এবারের মেলায় সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো আমাদের দেশি পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। বায়াররা আমাদের পণ্যে আকৃষ্ট হচ্ছে। এর ফলে আগামীতে আমাদের আমদানি কমে যাবে। এ ছাড়া রফতানিতে আমাদের পোশাক খাতের নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য পণ্য রফতানি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি চিন্তা ও চেতনায় আমাদের আরো এগোতে হবে। তোফায়েল আহমেদ বলেন, পূর্বাচলে ৩০ একর জমিতে চায়না কোম্পানি বাণিজ্যমেলার স্থায়ী জায়গায় নির্মাণ কাজ করছে। হয়তো একটু সময় লাগবে। এবারের মেলায় রফতানি আদেশ ভালো হয়েছে। গেলবার আমাদের রফতানি হয়েছিল ৪১ বিলিয়ন ডলার। এবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫ বিলিয়ন ডলার। ২০৪১ সালে আমাদের রফতানি হবে ৬০ বিলিয়ন ডলার। সবক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো করছে।
তিনি বলেন, বিগত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ প্রমাণ করে দিয়েছে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। তাই এখন অনেক ভালো লাগে যখন সংসদে দেখি কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, কোনো খুনি নেই। আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যাগুলো একসঙ্গে বসে সুন্দরভাবে সমাধান করতে সরকার আন্তরিক। রেজওয়ান হোসেন বলেন, এবার মেলায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ভিশন ২০২১, ২০৪১ ও ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করা। এজন্য আমাদের ব্যবসা বাড়াতে হবে। আর ব্যবসা বাড়াতে পণ্যের মানের পাশাপাশি সেবার মান বাড়াতে হবে। এখন অনেক কোম্পানিই আসছে যারা সেবাগ্রহণ করতে চাচ্ছে। আশা করি, আমরা সেবা রফতানির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য স্তরে পৌঁছাতে পারবো। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যমেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিজয় ভট্টাচার্য বলেন, বাণিজ্যমেলায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ১১০টি প্যাভিলিয়ন, ৮৩টি মিনি প্যাভিলিয়ন এবং রেস্তোরাঁসহ ৪১২টি স্টলে মোট ৬৯৫টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এদের মধ্যে ২২টি দেশের ৫১টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মেলায় এবারই প্রথম অনলাইনে টিকিট বিক্রি করা হয়। এতে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। মেলায় আসা ক্রেতা-দর্শনার্থীদের জন্য ৫টি বিশ্রামাগার ও প্রতিবন্ধীদের জন্য হুইল চেয়ার ছিল। উল্লেখ্য, গত বছর ২৩তম আসরে ২০ মিলিয়ন ডলার বা ১৬৫ কোটি ৯৬ লাখ টাকার রফতানি আদেশ পেয়েছে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো। তার আগের বছর ২২তম আসরে মেলায় ২৪৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বা ৩০ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলারের স্পট অর্ডার এসেছিল। ২০১৬ সালে ছিল ২৩৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। রাজনৈতিক সহিংসতার দু’বছর ২০১৪ ও ২০১৫ সালে রফতানির আদেশ ছিল যথাক্রমে ৯৫ কোটি ও ৮০ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০১৩ সালে রফতানি আদেশ এসেছিল ১৫৭ কোটি টাকা।
পুরস্কার পেল ৪২ প্রতিষ্ঠান: এবারের মেলায় ১২ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছে ৪২ প্রতিষ্ঠান। সেরা প্রিমিয়াম প্যাভিলিয়নের পুরস্কার পেয়েছে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এ ছাড়া ভ্যাট প্রদানকে উৎসাহিত করতে মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তিন প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ভ্যাট প্রদানকারী হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। গতকাল মনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাণিজ্যমেলা প্রাঙ্গণে সমাপনী অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে ট্রফি তুলে দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এ সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব এস এম রেজওয়ান হোসেন এবং রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্যসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, মেলায় অনন্য সম্মাননা পুরস্কার, সেরা প্যাভিলিয়ন, সেরা স্টল, সেরা রেস্তোরাঁ ও সেরা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিতে ৪২ প্রতিষ্ঠানের অনন্য সম্মাননা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছে একটি, অন্যান্য ক্যাটাগরিতে প্রতিটিতে তিনটি করে পুরস্কার দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১৩ প্রতিষ্ঠানকে গোল্ড কালার ট্রফি, ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে সিলভার ট্রফি এবং ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ব্রাস ট্রফি প্রদান করা হয়। এদিকে ভ্যাট প্রদানকে উৎসাহিত করতে মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তিন প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ভ্যাট প্রদানকারী হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো-হাতিল কমপ্লেক্স লিমিটেড, ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এবং এসকোয়ার ইলেক্ট্রনিক্স লিমিটেড। গোল্ড কালার্ড ট্রফিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড সেরা প্রিমিয়ার প্যাভিলিয়নে, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ সেরা প্রিমিয়ার ও সেরা সাধারণ প্যাভিলিয়নে দুইটি, জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার সেরা সংরক্ষিত প্যাভিলিয়নে, বেস্ট ফরেন প্যাভিলিয়ন ১ এ হাদেক্স হালি ডেরি টেক্সটাইল ও জাপান হালাল কোম্পানি, বিআরবি ক্যাবল ইন্ড্রাস্ট্রিজ সেরা মিনি প্যাভেলিয়ন ১, বঙ্গ মিলার্স লিমিটেড সেরা সাধারণ মিনি প্যাভেলিয়ন ১, বাংলাদেশ পোস্ট অফিস, এমসিএনআরওই কনজ্যুমার প্রোডাক্ট ফরেন মিনি প্যাভেলিয়নে অ্যাম্বাসি অব নেপাল ফরেন মিনি প্যাভেলিয়নে, মেসার্স হেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স ও ফরচুন টেক। এছাড়া সিলভার ও ব্রাস ট্রফিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো-আখতার ফার্নিচার্স, আকিজ সিরামিকস, মিনিস্টার হাইটেক পার্ক, ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড, গোল্ডেন হারভেস্ট এগ্রো, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, আরএফএল প্লাস্টিক, এসএমই ফাউন্ডেশন, কারা অধিদপ্তর, তওফিকা ফুড অ্যান্ড এগ্রো, ম্যাটাডোর বলপেন, আকিজ প্লাস্টিক, বঙ্গ ব্রেকার্স, এনার্জিপ্যাক ফ্যাশনস, আমলকি হারবাল, মেসার্স স্ট্যান্ডার্স ফিনিশ ওয়েল কোম্পানি, বেঙ্গল মিট প্রসেসিং ইন্ড্রাস্ট্রিজ, মিল্ক ভিটা, বিএসসিআইসি, ডিউরেবল প্লাস্টিক, বঙ্গ বিল্ডিংস ম্যাটারিয়ালস, সারা লাইফ স্টাইল, গ্রিন ডট লিমিটেড, মেসার্স রানা টেক্সটাইল, বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ড্রাস্ট্রিজ, জারা সুকস ইন্ড্রাস্ট্রিজ, গৃহিনী ফুড প্রোডাক্টস ও মা এন্টারপ্রাইজ। উল্লেখ্য, দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং বিদেশি বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এবারের বাণিজ্যমেলা ছিল স্বার্থক আয়োজন। মাসব্যাপী এ মেলায় দর্শনার্থী-ক্রেতা আগমনের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগ্রহী ক্রেতা আমদানিকারক মেলা পরিদর্শন করেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি বিদেশি ডেলিগেশনও সরেজমিনে মেলা পরিদর্শন করেছেন।
এফএন/এমআর