মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে॥
করোনার ঝুঁকি নিয়েই সাগরপাড়ের কলাপাড়ার জনপদে স্বাস্থ্যসেবার জন্য এখনও মানুষ ছুটছে হাসপাতালে। তবে করোনার আগের সেই স্বাভাবিক দৃশ্যপট নেই। শঙ্কাজনকহারে কমেছে হাসপাতালমুখি রোগী। যেসব রোগী যাচ্ছেন, নিতান্ত দায় ঠেকে। শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে তারা হাসপাতালে যাচ্ছেন। শঙ্কার পাশাপাশি হয়রাণি আর বঞ্চনা থাকলেও যতটুকু চিকিৎসা পাচ্ছেন তা নিয়ে অধিকাংশ রোগী স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এখানকার অধিকাংশ চিকিৎসক করোনা ঝুঁকিতে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। আবার বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে রোগীরা দু’একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কলাপাড়ার এ হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসা সেবা চলছে স্বল্পপরিসরে। হাসপাতালমুখি রোগী আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। মানুষের মধ্যে করোনাকালীন সচেতনতা বেড়েছে। বারবার হোত ধোঁয়ার অভ্যাস বেড়েছে। স্যনেটাইজার ব্যবহার করছে। নিরাপদ পানির ব্যবহার বেড়েছে। ফলে কমেছে পেটের পীড়াসহ পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা। এমনকি স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত আগের চেয়ে কমেছে। খবর নির্ভরযোগ্য সূত্রের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫০ শয্যার কলাপাড়া হাসপাতালে করোনার আগে এবছরের মার্চ মাসের ২ তারিখে বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নেয়া রোগীর সংখ্যা ছিল মোট ২২৩ জন। যার মধ্যে পুরুষ ৬৩ জন, আর নারী ১৬০ জন। এভাবে ৩ মার্চ ২০৫ জন এবং ৪ মার্চ ২৬০ জন। তিনদিনে মোট নারী রোগী সেবা নিয়েছে ৪৬৭ জন, আর পুরুষ রোগী চিকিৎসা সেবা নিয়েছে ২২১ জন। অথচ করোনা সংক্রমনের পরে হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। ২৭ মে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয় মাত্র ৩৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১৭ জন, আর নারী ২১ জন। ২৮ মে চিকিৎসা নিয়েছে মাত্র ৩১ জন। পুরুষ ১০ জন, আর নারী ২১ জন। অথচ করোনার আগে হাসপাতালের অভ্যন্তরীন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল দৈনিক গড়ে ৮০-৯০ জন। আর এখন তা পৌছেছে ১০-১৫-২০ জনে। এর মধ্যে আবার অধিকাংশ মারামারির। করোনার আগে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে জরুরি, অন্তর্বিভাগ এবং বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ছয় হাজার ৭১৭ জন। নভেম্বর মাসে ছয় হাজার ৪০৩ জন এবং ডিসেম্বর মাসে ছয় হাজার ১৩ জন। সেখানে করোনা সংক্রমনের পরে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে জরুরি, বহির্বিভাগ ও অন্তঃবিভাগ মিলে মোট চিকিৎসা নেয়া রোগীর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৬৪২ জন। কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। পরিসংখ্যানের এ সুত্র ধরে গ্রাম-শহরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুব বেশি শঙ্কাজনক; এমন রোগী হাসপাতালে আসছেন। ছুটছেন চিকিৎসকের কাছে। এছাড়া শতকরা ৬০ ভাগ রোগী স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। এদের কাছ থেকে প্রতিকার না পেয়ে প্রতিদিন গড়ে ২০-২২ জন রোগী মোবাইল ফোনে হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শ নেয় বলে উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডাঃ চিন্ময় হাওলাদার নিশ্চিত করেছেন। পল্লী চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা সেবা নেয়া রোগীর সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। তাঁদের কাছ থেকেও মোবাইলে চিকিৎসা পরামর্শ নেয়া রোগী বাড়ছে। তবে স্বস্তির খবর, করোনার এই সঙ্কটকালে কলাপাড়ায় স্বাভাবিক মৃত্যুর হার কমেছে। কমেছে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার। স্বাস্থ্যবিভাগের দেয়া তথ্যানুসারে, কলাপাড়ায় ২০১৯ সালে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ৩৬২ জনের। ওই বছরের মার্চ মাসে মারা গেছেন ৩০জন। অথচ করোনাকাল ২০২০ সালের মার্চ মাসে মারা গেছেন ১৯ জন। এপ্রিল মাসে ২৬ জন। আর এবছরের (২০২০)এপ্রিল পর্যন্ত এই চার মাসে মারা গেছেন মোট ১১৭ জন। এছাড়া নবজাতকসহ শিশু মৃত্যু ছিল ২০১৯ সালে (০-৫ বছর) ৪০ জন। সেখানে ২০২০ সালে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে শিশুমৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। একইভাবে ২০১৯ সালে মাতৃমৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। আর এবছরে এই চার মাসে মারা গেছেন মাত্র একজন। চিকিৎসকরা মনে করছেন, করোনার কারনে যাবাহনকেন্দ্রীক দূর্ঘটনা কমে যাওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। এছাড়া লকডাউনকালীন মানুষ ঘরে থাকায় রাস্তার ধুলাবালীসহ দূষণ মুক্ত পরিবেশে থাকছেন। রয়েছেন পরিবারের সকল সদস্যদের সঙ্গে একটি স্বস্তিদায়ক, সুখকর পরিবেশে। করোনাকেন্দ্রীক দুশ্চিন্তা থাকলেও মানসিকভাবে অনেকটা স্বস্তিও রয়েছে বাসায় থাকা এসব মানুষ। বিশ্রাম নিতে পারছেন। অত্যধিক গরম থেকে রক্ষায় বিশ্রামে থাকার সুযোগ পেয়ে রোগ থেকে বহুলাংশে মুক্তি মিলছে মানুষের। সবচেয়ে বেশি সুবিধায় রয়েছে মানুষ তার বাসায় তৈরি অনেকটা ভেজাল মুক্ত খাবার খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এটি রোগ-বালাই থেকে সুস্থ থাকার সবচেয়ে একটি ভাল দিক বলে দাবি করলেন এই চিকিৎসক। এসব কারণে পেটের পীড়াজনিত এবং পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবও কমেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ চিন্ময় হাওলাদার জানান, করোনার কারণে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা অনেক বেড়েছে। নিরাপদ পানির ব্যবহার বেড়েছে। বার বার হাত ধোঁয়া, স্যানেটাইজার ব্যবহার করছেন। এসব কারণে পেটের পীড়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব কমেছে। মানুষ আমাশয়, টাইফয়েড রোগ থেকে বহুলাংশে পরিত্রাণ পাচ্ছেন। আগের চেয়ে এ ধরনের রোগী কমেছে। পৌরশহরের নাফিজা ফার্মার মালিক আব্দুল খালেক জানালেন, করোনার আগে ফি-মাসে টাইফয়েডে আক্রান্ত কমপক্ষে ৫/৭ জন রোগীকে বিভিন্ন ওষুধসহ ইনজেকশন (টু-গ্রাম) পুষ করতে হতো। কিন্তু করোনা পরবর্তী দুই-একজন পাওয়া যায়। করোনাকালে মানুষের ভীতি বেড়েছে, কিন্তু সচেতনতার কারনে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই কমেছে। যদিও হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা কমেছে। কিন্তু নিকটস্থ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র ছাড়া এখানকার ৩৭ টি কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা পরামর্শ নেয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পাচ্ছেন মানুষ বিনামূল্যের ওষুধপত্র। বালিয়াতলী ইউনিয়নের কাংকুনিপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচপি ইসরাত জাহান জানান, করোনাকালীন ঝুঁকিতেও প্রতিদিন গ্রামের মানুষ চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। তবে মোবাইলে পরামর্শ নেয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে বলে জানালেন এ স্বাস্থ্যসেবী। বালিয়াতলী স্টেশনে বাড়ি ওয়ার্কশপ মিস্ত্রী মাসুম ফিটারের। করোনাকালে কোমরে ব্যথা পেয়েছেন। তার হাসপাতালে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন থাকলেও করোনার কারণে বাড়িতে বসে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকসহ পরিচিত চিকিৎসকের সঙ্গে মোবাইলে পরামর্শ করে চিকিৎসা নিয়ে এখন সুস্থবোধ করছেন।
তবে সচেতনমহলসহ স্থানীয় সকল শ্রেণির মানুষের দাবি যেসব ইউনিয়নে মেডিকেল অফিসার পদায়ন রয়েছেন তারা যেন নির্দিষ্ট সময় কর্মস্থলে থাকেন। এছাড়া যারা মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন তারাও মাঠের মানুষের খবরে মাঠেই থাকেন; এমন প্রত্যাশা সকলের। সাধারণ মানুষ করোনাকালের এই যুদ্ধ মোকাবেলায় সামনের যোদ্ধা চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তা নিতে প্রত্যেক ইউনিয়নে দায়িত্বরত চিকিৎসকের কর্তব্যকালীন সময়কালসহ তাঁদের যোগাযোগের নম্বরটা টানিয়ে দেয়ার দাবিও করেছেন।
এমইউএম/এনবি