সুনামগঞ্জ সাগরকন্যা প্রতিনিধি ॥
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে সালিশের রায় না মানায় একটি পরিবারকে চারমাস ধরে একঘরে করে রাখার অভিযোগ উঠেছে মান্নারগাঁও গ্রামের পূর্বপাড়া এলাকার প্রভাবশালী সমাজপতিদের বিরুদ্ধে। সালিশের রায় অনুযায়ী ১০ হাজার টাকা জরিমানা পরিশোধের পরও ওই পরিবারের একজন মাথা ন্যাড়া না করায় এখনও তারা একঘরে। বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
একঘরে হওয়া পরিবারের গৃহকর্তা অনিল চন্দ্র দাসসহ অন্য সদস্যরা অভিযোগ করেন, অনিল চন্দ্র দাস ও তার ছোট ভাই নিধু রঞ্জন দাসের মধ্যে জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। চার মাস আগে এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তাদের বাড়িতে পাড়ার লোকজন সালিশে বসেন। সালিশ চলাকালে অনিল ও নিধুর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মারামারি বেধে যায়। এতে নিধু আহত হন। এরপর মারামারির ঘটনার শালিস করতে আবারও বৈঠকে বসেন পূর্ব পাড়ার লোকজন। সালিশ বৈঠকে অনিল দাসের পরিবারকে ১০ হাজার জরিমানা করা হয়। একইসঙ্গে অনিক দাস তার চাচা নিধু দাসকে মাথায় আঘাত করেছে এই অভিযোগে হিন্দু শাস্ত্রমতে তার দেহশুদ্ধির জন্য প্রায়শ্চিত্ত করে মাথা ন্যাড়া করার রায় দেওয়া হয়।
অনিল দাস জানান, ‘আমার ছেলে অনিক দাস এবার দশম শ্রেণিতে পড়ে। আপন চাচাকে মারধর করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এজন্য আমাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। জরিমানার পাশাপাশি গ্রাম্য শালিসে আরেকটি রায় ছিল, বড়দের গায়ে হাত তোলায় শাস্ত্র অনুযায়ী দেহশুদ্ধির জন্য অনিককে মাথা ন্যাড়া করতে হবে। কিন্তু এটি না মানায় আমার পরিবারকে চার মাস ধরে একঘরে করে রাখা হয়েছে। আমাদের সঙ্গে গ্রামের অন্যান্যের মেলামেশা কিংবা চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা আছে। এ কারণে আমরাও গ্রামের অন্য কারও সঙ্গে মিশতে পারছি না। অন্য কেউ আমাদের বাড়িতে যেতে চাইলে বাধা দেওয়া হচ্ছে। গ্রামের মাঠে গরু চড়াতেও নিষেধ রয়েছে।’ এ বিষয়ে দোয়ারাবাজার থানায় ৯ জনের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলেও জানান অনিল চন্দ্র দাস। অনিল দাসের স্ত্রী রতœা রানী দাস জানান, ‘আমরা জরিমানার টাকা নিয়ে পঞ্চায়েতের কাছে আবেদন জানাই, ছেলে যেহেতু স্কুলে পড়ে তাই তার মাথা ন্যাড়া করার রায়টি যেন বাদ দেওয়া হয়। এর বদলে বাবা হিসেবে তিনি (অনিল) মাপ্রার্থনা করবেন। কিন্তু এটি পঞ্চায়েত না মেনে তাদের একঘরে রাখার সিদ্ধান্ত দেন।’
অনিকের মা আরও বলেন, ‘অনিক তার চাচাকে মারেনি। মাথা ন্যাড়া করার রায় শুনেই অনিক ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় এবং জানায় তাকে জোর করে মাথা ন্যাড়া করালে সে আত্মহত্যা করবে। এরপর আমরা গ্রামের মুরব্বিদের বিষয়টি বুঝিয়ে বলি। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।’
অনিল দাস আরও বলেন, ‘আমি গ্রামের অন্যপাড়ার লোকদেরও বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু পাড়ার মুরব্বিরা কেউ কোনও কথা শুনছেন না। এখন কেউ আমাদের সঙ্গে চলাফেরা করে না। আমাদের বাড়ির কোনও অনুষ্ঠানে অন্যরা আসে না।’ তিনি জানান, গত ২৪ জানুয়ারি তার বাড়িতে তাদের গুরু গোঁসাই এসেছিলেন। এজন্য গ্রামের অন্যান্যের প্রসাদের জন্য তিনি নিমন্ত্রণ করেন। গ্রামের অন্যপাড়ার কিছু লোকজন তার বাড়িতে আসতে চাইলে পথে বাধা দেওয়া হয়। এরপর তিনি থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অনিল দাস ও অন্যান্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শালিসে নেতৃত্বে দিয়েছেন পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা রবীন্দ্র দাস, ধিরু দাস, ভূপেন্দ্র দাস, বকুল দাস, পুতুল দাস, দেবল দাস, রনজিৎ দাস চিনু দাস, বিলম্ব দাসসহ আরও অনেকে। শালিসে ৪নং মান্নারগাঁও ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দীপক দাসও উপস্থিত ছিলেন।
পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা প্রদীপ দাস জানান, ‘সালিশেই অনিকের মাথা ন্যাড়া করার রায় দেওয়া হয়। সালিশকারীরা কোথাও ফোন করে একজন প-িতের কাছ থেকে গুরুজনদের আঘাত করার শাস্তি হিসেবে এই মাথা ন্যাড়া করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আসেন। কিন্তু অনিকের পরিবার সেটি না মানায় তাদের একঘরে করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। আমাদেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে তাদের সঙ্গে মেলামেশা না করতে।’
গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা নিরঞ্জন দাস জানান, ‘অনিলের বাড়িতে গুরুদেব আসার পর আমাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। আমরা কয়েকজন ওই বাড়িতে যেতে চাইলে পথে ওই পাড়ার কিছু লোক আমাদের বাধা দেয়। এর সময় তাদের সঙ্গে লাঠিসোঁটাও ছিল।’ শালিশে উপস্থিত অবনি মোহন দাস ওরফে পাখি দাস মাথা ন্যাড়া করার রায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘সেটা অনিলই কোনও প-িতের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনেছে। যেহেতু তার ছেলে অপরাধ করেছে তাই তার মাথা ন্যাড়া করলে ছেলের দেহশুদ্ধি হবে। এটা শাস্ত্রের কথা, আমাদের না।’ একঘরে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা নয়, অনিলই পঞ্চায়েতের সঙ্গে থাকতে চায় না। সে যখন শাস্ত্র মানবে না তখন আমরা বলেছি, তুমি তোমার মতো চলো, আমরা আমাদের মতো চলবো।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য দীপক দাস জানান, ‘একঘরে করে রাখা বা মাথা ন্যাড়া করার বিষয়টি আমি জানি না। তবে থানায় অভিযোগ দেওয়ার পর আমরা অনিলের পরিবারকে নিয়ে বসতে চেয়েছিলাম। তবে তারা আমাদের ডাকে আসেনি।’
মান্নারগাও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবু হেনা আজিজ বলেন, ‘একঘরে করে রাখার বিষয়টি অমানবিক ও আইন বিরুদ্ধ কাজ। এ বিষয়ে আমাকে অবহিত করা হয়নি। এরপরও আমি খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো।’
দোয়ারাবাজার থানার এসআই সিদ্দিকুর রহমান জানান, ‘অনিলের অভিযোগ ছিল অন্যপাড়ার লোকদের তাদের বাড়িতে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমি সরেজমিনে গিয়ে সেটা দেখে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে বসে মীমাংসা করার জন্য বলে এসেছিলাম। এজন্য উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একপ সেটিতে যায়নি বলে শুনেছি। এখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামি সাত দিনের মধ্যে উভয়পকে নিয়ে থানায় বসে বিষয়টি মীমাংসা করে দেবো। যদি সেটিও না হয় তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এফএন/কেএস