আসিতেছে শুভদিন
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
…………….. -কাজী নজরুল ইসলাম
বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কুলি-মজুর কবিতার এই পংক্তি গুলোতেই মানব সভ্যতায় শ্রমজীবী মানুষের অবদানের কথা ফুটে উঠেছে। শ্রমিকদের অবদানের কথা ছাপিয়ে শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ, কষ্ট, চাপা ক্ষোভ আর না বলা চাওয়াই হয়ে উঠেছেএই কবিতার প্রধান মর্মবাণী । মানব সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষতায়, যুগে যুগে শ্রমজীবী মানুষের অবদান অপরিসীম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি এই পরিশ্রমী মানুষগুলোই সবথেকে বেশি নির্যাতিত,অধিকার বঞ্চিত এবং নিষ্পেষিত। এ যেন ঠিক, শ্রমজীবী মানুষরা নিজেদের গড়া অট্টালিকার নিচে চাপা পড়ে আছেন। যাদের বোবা কান্না, অধিকারের কথা শোনার মত কেউ নেই।
এই ইতিহাস হাজার বছরের । ইতিহাসের পাতার সংখ্যা বাড়লেও শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। তাদের অধিকার নিশ্চিত হয়নি। তাই শ্রমজীবী মানুষরা যুগে যুগে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। আত্মহুতি দিয়েছেন, রক্তের বিনিময়ে দাবি করেছেন নিজেদের প্রাপ্য অধিকার।
শ্রম আন্দোলনের সব থেকে সফল এবং তাৎপর্য পূর্ণ সময় ছিল ১৮৮০ এর দশক। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক মালিকপক্ষকে দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণের দাবি জানায়। কারণ এতদিন কারখানার শ্রমিকরা দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতো। কিন্তু কাজ অনুপাতে পারশ্রমিক ছিলো খুবই কম। এ দাবি পূরণের সময় হিসেবে ১৮৮৬ সালের ০১ মে-কে নির্ধারণ করেন শ্রমিকরা। কিন্তু কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের এ দাবি কানে তোলেননি। ফলাফলে ১৮৮৬ সালের ০৪ মে শিকাগোর হে মার্কেট নামক স্থানে ফের আন্দোলন গড়ে তোলেন শ্রমিকরা। এসময় হে মার্কেট স্কয়ারে শ্রমিক পক্ষে বক্তব্য রাখেন আমেরিকান লেবার অ্যাক্টিভিস্ট ‘অগাস্ট স্পিস’। উদ্বেলিত শ্রমিকদলের কিছু দূরেই ছিলো পুলিশ। এসময় সবার অলক্ষ্যে হঠাৎ পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ হলে নিহত হন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। তাৎক্ষণিক এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে, পুলিশের গুলিতে নিহত হন প্রায় ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক। পুলিশের ওপর কে বা কারা বোমা হামলা করেছিলো তা সঠিক জানা না গেলেও, পুলিশ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ও আটক করা হয় অগাস্ট স্পিসসহ আরও আটজনকে। পরের বছর ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর অগাস্ট স্পিসসহ অভিযুক্ত নির্দোষ ছ’জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অভিযুক্ত বাকি দু’জনের একজন কারাবন্দি অবস্থায় আত্মহত্যা করেন ও অন্য একজনের ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয়।
ফাঁসিতে ঝুলার আগ মুহূর্তে অগাস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today.”
হ্যা অগাস্ট স্পীজের এই কথা সত্য হয়েছিল।
শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের দাবিতে তাদের এই অসামান্য ত্যাগের স্বীকৃতি স্বরুপ। ১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছর থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’।
আজ পহেলা মে ২০২০। আরো একটি মে দিবস আমরা পালন করছি। কিন্তু সত্যি কি আমরা শ্রমজীবী মানুষের যে অধিকারের জন্য মেদিবস পালন করছি তা পূরণ করতে পেরেছি?
কাজের তুলনায় ন্যায্য মজুরি, শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও জীবনের নিরাপত্তা সর্বোপরি মালিক-শ্রমিক একতা নিশ্চিত করাই ছিল ১৮৮৬ সনের আন্দোলনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। আজ ১৩৪ বছর পরেও কি এই এই উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে?
বাস্তবতা বলে আজও আমরা সভ্যতার কারিগর শ্রমিক-মজুরদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি। আমাদের উন্নয়নশীল দেশ, বাংলাদেশের পেক্ষাপটে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান সেই সাক্ষ্যই দেয়ঃ-
প্রতিবেশী ও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার বাংলাদেশেই কম। গত তিন বছরে বাংলাদেশে যে হারে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। এ ছাড়া চীনে প্রকৃত মজুরি বাড়ছে অনেক বেশি হারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ফ্ল্যাগশিপ’ প্রতিবেদন ‘গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট ২০১৬/২০১৭: ওয়েজ ইনইকুয়ালিটি ইন ওয়ার্ক প্লেসে’ বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে মোট ১১ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতে তা ১৬ দশমিক ৩, পাকিস্তানে ১১ দশমিক ১, ভিয়েতনামে ১২, কম্বোডিয়ায় ৪৪ দশমিক ৩ (দুই বছরে), থাইল্যান্ডে ১৬ দশমিক ৯ ও চীনে ২১ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বেড়েছে।
বাংলাদেশ যে অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত, সেই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গত তিন বছরে মজুরি বেড়েছে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৫ সালে এ অঞ্চলে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ৪ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে ২০১৩ সালে গড় মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। পরবর্তী দুই বছরে ২ দশমিক ৪ শতাংশ হারে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে আইএলওর প্রতিবেদনে।
প্রকৃত মজুরি হিসাব করা হয় একটি দেশের মজুরি বৃদ্ধির হারের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করে। এটাকেই একজন কর্মজীবীর প্রকৃত আয় বৃদ্ধি হিসেবে গণ্য করা যায়। প্রকৃত মজুরি উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়লে কর্মজীবীর জীবনযাত্রার মানে কোনো পরিবর্তন আসে না।
তাই ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল আমাদের দেশে এই নিম্ন মজুরী হারের ফলে শ্রমিকদের জীবন যাত্রার মান অত্যন্ত নিম্নমানের যা তাদের কাজে প্রভাব ফেলে,আমাদের উন্নতির চাকা কে শ্লথ করে দিচ্ছে।
শ্রমিক অধিকারের অন্যতম অঙ্গ শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ এবং জীবনের নিরাপত্তা, সেক্ষেত্রেও রয়েছে যথেষ্ট নিরাপত্তার ঘাটতি । ১৮৮৬ সালের শিকাগোতে যে আট ঘণ্টার দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই আট ঘণ্টার বক্তব্য এখন শুধু খাতা-কলমে বা মুখে মুখে। গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউই তা মানছে না। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী “কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।”
কিন্তু বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, নিরাপত্তাজনিত কারণে ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭৩৮ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৭ হাজার ৩৬১ জন। কর্মস্থলে নিরাপত্তার কারণে এতো শ্রমিকের মৃত্যুর মিছিল, তারপরেও প্রশাসন শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে অনেক উদাসীন। বিশ্বের উন্নত দেশে কাজে গিয়ে কোন শ্রমিক হতাহত হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। আর বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কিংবা মালিকপক্ষ শ্রমিকের পাশে এগিয়ে এলেও না আসার তালিকাটা বেশ বড়। শ্রম আইন বলছে, ন্যূনতম একশো শ্রমিক কোনো কারখানায় কাজ করলে তাদের জীবনবীমা বাধ্যতামূলক। কিন্তু, এক্ষেত্রেও বাস্তবতা ভিন্ন।
“মালিক-শ্রমিক একতা, শিল্পোন্নয়নের মূলকথা’।
‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, উন্নয়নের শপথ করি’।
শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ;এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
মে দিবসের মর্মবাণী, শ্রমিক মালিক ঐক্য জানি’।
গত কয়েক বছরে এই প্রতিপাদ্য গুলোকে সামনে রেখেই দেশে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। কিন্তু এই মালিক শ্রমিক একতার বিষয়টিতে বাংলাদেশের বাস্তবতা কি?
শ্রমিকরা বলছেন, মালিকদের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক থাকার কথা তা মালিকপক্ষ রাখছে না। আর মালিকপক্ষের দাবি শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের অত্যন্ত সুসম্পর্ক বিদ্যমান। এই দ্বিমুখী বক্তব্যের প্রকৃত সত্যতা খুজে পাওয়া যায় শ্রমিকদের মজুরী এবং তাদের নিরাপত্তায় মালিক শ্রেণীর গৃহিত পদক্ষেপের মাধ্যমে৷ বছর বছর শ্রমিকদের রাস্তায় আন্দোলন থেকেই আন্দাজ করা যায় বাস্তবে মালিক-শ্রমিকের কতটা ঐক্য রয়েছে! শ্রমিকদের বিশ্বস্ততার কমতি কিংবা মালিকদের ন্যায়বিচার কমতি যাই হোক না কেন মালিক শ্রমিক ঐক্য এখনো প্রতিপাদ্য আর বইয়ের পাতায় বন্দি।
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে ইসলামের শিক্ষা কি?
ইসলাম পূর্ব যুগে শ্রমজীবী মানুষদের অধিকার তো দূরের কথা তাদের মানুষই মনে করা হত না। আরবের বর্বর মানুষরা হাটে বাজারে দাস-দাসী কেনা বেচা করত। প্রাপ্য সম্মান আর নূন্যতম সহানুভূতির বদলে তাদের যুগের পর যুগ দাসত্বের শৃংখলে বন্দি রাখা হত! সমাজের মূল ধারার অংশ হয়ে যাওয়া এই দাস প্রথা ভেঙে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সহজ বিষয় ছিল না। কিন্তু এই অবস্থার বিবেচনায় কুরআন সর্বপ্রথম আদেশ দেয়ঃ-
তোমাদের অধিকারভুক্তদের(দাস-দাসী,চাকর-চাকরাণী, অধিনস্থ কর্মচারী) সাথেও সদয় ব্যবহার কর।- সূরা নিসা (৩৭)
এই আদেশের মাধ্যমে কুরআন দাসদের উপর চলা অকথ্য অত্যাচারকে রোধ করে দাসদের প্রতি মানবিকতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যান্য সবার মত তাদের অধিকার রয়েছে বলে ঘোষণা করেছেন।
এরপর ইসলাম ধীরে ধীরে মানুষের এই হিংস্র প্রথার মুলউৎপাটন করায় সচেষ্ট হয়। হযরত মহানবী (সা.) মুসলমানদের ক্রীতদাস মুক্তির উৎসাহ প্রদান করে বলেছেনঃ-
আবূ হুরায়রা (রা.) সূত্রে নবী (সা.) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেছেনঃ যে লোক একটি মুসলিম গোলাম আযাদ করবে আল্লাহ্ সে গোলামের প্রত্যেকটি অঙ্গের বিনিময়ে জাহান্নামের আগুন হতে তার প্রত্যেকটি অঙ্গকে মুক্ত করবেন।
(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬৭১৫)
এভাবে হুযুর (সা.) যাকাত আদায়, কাফফারা, ক্ষতিপূরণ আদায়, যুদ্ধবন্ধীদের মুক্তি, কারো অপরাধের শাস্তি সহ সকল নুন্যতম কারণে এমন কি বিয়ের মোহরানা স্বরুপ মুসলমানদের মাধ্যমে ক্রীতদাস মুক্তি করিয়েছেন। কারণ ইসলাম সকল মানুষের অধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
দাস প্রথার মূলে কুঠারাঘাত করার পর ইসলাম শ্রমজীবী মানুষের নূন্যতম অধিকার আদায়ে নির্দেশ দিয়েছে। তাদের ন্যায্য মজুরী আদায়, সহজতর কাজের বিধান এবং তাদের প্রতি ভ্রাতৃত্ব প্রতীম আচরণের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
হযরত নবী করীম (সা.) শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি আদায়ের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে বার বার সতর্ক করেছেনঃ-
আবূ সা’ঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন শ্রমিককে কাজে লাগাবে সে যেন তাঁর ন্যায্য পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে কাজে লাগায় ।
(বুলুগুল মারাম, হাদিস নং ৯১৪)
আজকের যুগে হরহামেশাই দেখা যায় যে, মালিকশ্রেণী মাসের পর মাস শ্রমিকদের বেতন দেয় না। এমনকি করোনার এই বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে কিছু মালিক শ্রমিকদের বেতন আটকে রেখেছে। কিন্তু হুযুর (সা.) কাজ আদায়ের সাথে মজুরী পরিশোধের তাগিদ দিয়েছেন।
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন যে, কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোন আযাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর এক ব্যক্তি, যে কোন মজুর নিয়োগ করে তার হতে পুরো কাজ আদায় করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না।
(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২২২৭)
একই ভাবে,
আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ শ্রমিকের দেহের ঘাম শুকাবার পূর্বে তোমরা তার মজুরী দাও।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৪৪৩)
হুযুর (সা.) শ্রমিকদের মজুরীর সাথে কাজের ধরণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতেরও নির্দেশ দিয়েছেন।
মা‘রূর (রহ.) থেকে বর্ণিতঃ
রাসুল (সা.) বলেছেন, জেনে রেখো, তোমাদের দাস-দাসী তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তা‘আলা তাদের তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। তাই যার ভাই তার অধীনে থাকবে, সে যেন নিজে যা খায় তাকে তা-ই খাওয়ায় এবং নিজে যা পরিধান করে, তাকেও তা-ই পরায়। তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দিও না, যা তাদের জন্য অধিক কষ্টদায়ক। যদি এমন কষ্টকর কাজ করতে দাও, তাহলে তোমরাও তাদের সে কাজে সহযোগিতা করবে।
(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩০)
ইসলাম মালিকশ্রেণীর প্রতি শ্রমিকদের দায়িত্ব ও বিশ্বস্ততার তাগিদ দিয়েছে।
আবূ মূসা (রা.) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সা.) বলেছেন, যে ক্রীতদাস আপন প্রতিপালকের উত্তমরূপে ইবাদত করে এবং আপন মনিবের যে হক আছে তা আদায় করে, তার কল্যাণ কামনা করে আর তার আনুগত্য করে, সে দ্বিগুণ পুণ্য অর্জন করবে।
(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৫৫১)
মালিক শ্রমিক সম্পর্কের আদর্শ চিত্র ইসলাম যেভাবে অংকন করেছে তার নজীর খুজে পাওয়া ভার।
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের কারো খাদিম খাবার নিয়ে হাযির হলে তাকেও নিজের সাথে বসানো উচিত। তাকে সাথে না বসালেও দু’ এক লোকমা কিংবা দু’ এক গ্রাস তাকে দেয়া উচিত। কেননা, সে এর জন্য পরিশ্রম করেছে।
(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৫৫৭)
সর্বোপরি নবী করিম (সা.) শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে এতটা গুরুত্ব দিয়েছেন যে তার মৃত্যুর মুহুর্তেও যে শেষ কথাটি মুখে ছিল তা হলো-
আলী (রা.) থেকে বর্ণিতঃ
নবী (সা.)-এর অন্তিম কথা ছিলঃ নামায! নামায! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করো (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদ আহমাদ)।
আদাবুল মুফরাদ, হাদিস নং ১৫৭
ইসলামের এই যুগান্তকারী শিক্ষা ও মহানবী (সা.) এর আদর্শ অনুসণে বর্বর আরব জাতি তাদের দাস-দাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
তাই বলা যায় ইসলামের এই আদর্শই পারে একশ চৌত্রিশ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যে দাবি উত্থাপিত হয়েছিল তা পূর্ণ করতে।
পরিশেষে, আর কোনো শ্রমিককে যেন তার কর্মস্থলে প্রাণ বিসর্জন দিতে না হয়, একজন শ্রমিক যেন সর্বোচ্চ নিরাপদ থাকেন, যেন তার অধিকার আদায়ে অনেক বেশিমাত্রায় সচেষ্ট হন, আগামীদিনের এই আমাদের চাওয়া।
মসীহ উর রহমান
ইসলামী লেখক।
mrtapu75@gmail.com