মেজবাহউদ্দিন মাননু, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥
কুয়াকাটা ও তৎসংলগ্ন গভীর বঙ্গোপসাগর এখন জেলেদের কাছে নিরাপদ জোনে পরিণত হয়েছে। নেই জলদস্যু আতঙ্ক। গেল এক বছরে জলদস্যুর হানায় পড়েনি কোন জেলে। তারা নির্বিঘেœ, মনের সুখে দিনরাত মাছ শিকার করছেন।
তিন/চার বছর আগে যেখানে নিত্যদিন জলদস্যুর হানায় জেলেরা থাকত তটস্থ। আহরিত মাছ থেকে শুরু করে জ¦ালানি, ট্রলার পর্যন্ত লুটে নিত। মুক্তিপণ গুনতে হতো লাখ লাখ টাকা। হামলেপড়া জলদস্যুর সশস্ত্র হানায় প্রতিদিন ঘটত হতাহতের ঘটনা। পেশায় দেখা দেয় ক্রান্তিকালের শঙ্কা। সেইসব শঙ্কা এখন কেটে গেছে। এখন আতঙ্কের সাগর পরিণত হয়েছে স্বস্তির অভয়াশ্রম। তারা মহিপুর, আলীপুর মোকাম থেকে সময়মতো বরফসহ প্রয়োজনীয় বাজার, সরঞ্জাম নিয়ে সাগরে ছুটছেন। অবস্থান করছেন নিরাপদে, থাকছেন যার যতদিন থাকার। বিগত ২০১৬ সাল থেকে পরপর তিনটি বছর এলিট বাহিনী র্যাবের ধারাবাহিক সফল অভিযানে কলাপাড়া উপকূলের হাজার হাজার জেলে, ট্রলারমালিকসহ আড়তমালিকরা এখন জলদস্যুমুক্ত সাগর পেয়েছেন। ইলিশসহ গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণরত জেলে, ট্রলারমালিক, আড়তমালিকদের কাছ থেকে এসব সুখবর মিলেছে।
কলাপাড়া উপকূলীয় ফিশিং বোট মাঝি সমিতির সভাপতি মোঃ নূরু মিয়া বলেন, ‘ সাগর এখন উম্মুক্ত। জলদস্যুতো দুরের কথা, গত এক বছরে জেলেদের মধ্যে একটা জাল টানাটানির ঘটনা ঘটেনি। র্যাবের অভিযানের কারণে এহন শান্তিতে মাছ ধরছে জেলেরা।’ নুরু মিয়া আরও জানালেন, কলাপাড়ার মহিপুর-আলীপুর মোকামের ট্রলারের জেলেরা সাধারণত কুয়াকাটা থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণপূবে, সাগরের ভেতরে (গভীরে) ৫০ কিলোমিটার এবং পশ্চিমে ৮০-৯০ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ শিকার করছে। এখানে হাজারো ফিশিং বোট মাছ শিকারে নিয়োজিত রয়েছে। গত এক বছরে কোন ডাকাতির খবর তারা পায়নি। আর এ বছর এখন পর্যন্ত ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে প্রচুর। এখনও প্রত্যেকটি ট্রলারে ৫০-৬০ থেকে এক শ’ মণ ইলিশ ধরা পড়ছে। জেলেরা জানায়, গত ৪০ বছরে এভাবে শীতসহ পুরো বছর মাছ ধরার ঘটনা ঘটেনি। তারা এবছর নিজেদেরকে মনে করছেন ভাগ্যবান। একদিকে সাগরে নেই জলদস্যুর ভয়। অপরদিকে দীর্ঘসময় ইলিশ পাওয়ায় বিগত বছরগুলোর লোকসান পুষিয়ে নিয়েছেন। এফবি খলিফা বোটের মাঝি মোঃ ইউসুফ জানান, এখন সাগরে থাকতে নিরাপদ মনে হয়। নিজেদের মতো জাল ফেলে মাছ ধরে কিনারে ফিরে আসেন। যা আগে কখনও দেখেননি।
এফবি তামান্না ট্রলারের মাঝি আব্দুল মান্নান জানান, তিন যুগ গভীর সাগরে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ শিকার করছেন। বলতে গেলে সাগরেই জীবন, সাগরই জীবিকা। মানুষটি ইতোপূর্বে দুই বার জলদস্যুর কবলে নিঃস্ব হয়েছেন। মার খেয়েছেন। গত এক বছরে কোন ডাকাতের কবলে পড়তে হয়নি। কেউ পড়েছেন এমন খবরটিও জানা নেই সাগর অভিজ্ঞ মানুষটির। সর্বশেষ দুই দিন আগে রবিবার সাগর থেকে ফিরেছেন মান্নান মাঝি, ছিলেন টানা ১৪দিন। প্রায় তিন লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। যেন স্বস্তির ঢেকুর গিলে কথা বলছিলেন তিনি। মান্নানের ভাষায়, ‘ রাইতে এহন সাগরে বোটের বাতির আলোয় শহর মনে অয়।’ যে সাগরে জীবনের আতঙ্ক নিয়ে ছুটছেন মানুষটি এখন তার কাছে সাগরই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে হয়। মান্নান মাঝি প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বারবার ‘মা’ সম্বোধন করলেন। আর্থিক স্বাচ্ছন্দে মান্নান মাঝি উদ্বেলিত। অনর্গল র্যাব, প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। একই কথা ব্যক্ত করলেন জাহাঙ্গীর মাঝি ও জাকির মাঝি। যেন র্যাবের সফল অভিযানে জেলেসহ কলাপাড়া উপকূলের এ পেশা সংশ্লিষ্টদের দিনকাল বদলে যাওয়ার কাহিনী। মোট কথা কলাপাড়ার কুয়াকাটাসহ গোটা উপকূলের জেলেসহ গভীর সাগরে ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ আহরণকারী এবং এ পেশা সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার মানুষ এখন নিশ্চিন্তে করছেন ব্যবসা-বাণিজ্য। এ পেশার মানুষগুলোর মধ্যে বইছে শান্তির সুবাতাস। আর্থিক স্বাচ্ছন্দের ধারা বইছে উপকূলের জেলে পরিবারে।
লতাচাপলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও কুয়াকাটা, আলীপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা জানান, সরকারের উদ্যোগে র্যাবের সফল অভিযানে কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর এখন জলদস্যুমুক্ত। জেলেরা নির্বিঘেœ মাছ শিকার করছে। ডাকাতি কিংবা জলদস্যুর কোন আতঙ্ক নেই। আনসার উদ্দিন মোল্লা এই সফলতা ধরে রাখার জন্য র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকার দাবি করেছেন।
র্যাব বরিশালের দেয়া তথ্যানুসারে ২০১৬ সাল থেকে র্যাবের চলমান অভিযানে সাগরের জলদস্যুর ২৭টি বাহিনী সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে শত শত অস্ত্র ও হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ। এছাড়া এখনও আত্মসমর্পনকৃত জলদস্যুদের র্যাবের মনিটরিংএ রাখা হয়েছে। এদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য উৎসাহ এবং বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
এমইউএম/এমআর