ঋণের দুষ্ট চক্রে জিম্মি দশমিনার নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ

প্রথম পাতা » সর্বশেষ » ঋণের দুষ্ট চক্রে জিম্মি দশমিনার নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ
শুক্রবার ● ১ ফেব্রুয়ারী ২০১৯


প্রতীকী ছবি

সঞ্জয় ব্যানার্জী, দশমিনা (পটুয়াখালী) থেকে॥
দারিদ্র্য বিমোচন শ্লোগান নিয়ে এনজিওগুলো সহজ শর্তে ঋন প্রদান, সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুযোর্গে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ ও জটিল রোগের (যক্ষ্মা) ফ্রি চিকিৎসা সহায়তার মত বিভিন্ন লোভনীয় কর্মসূচী থাকায় পটুয়াখালী দশমিনা উপজেলায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষগুলো আকৃষ্ট হয়ে ঋনের দুষ্ট চক্রে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ফলে উপজেলার নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষগুলো দারিদ্রো বিমোচন না হয়ে এক বা একাধিক এনজিও’র ঋনের ফাঁদে আটকিয়ে পড়েছে। সর্বহারা ভূমিহীন কৃষক পরিবার নিয়ে কাজ করা এমন সংগঠনের দাবী এনজিওরা দারিদ্রো বিমোচন করছেনা তৃনমুল মানুষের রক্তশোষণসহ ঘুম হারাম করে দিয়েছে। সরেজমিনে এ রকম চিত্রই পাওয়া যায়।
উপজেলা সদরের ১নং ওয়ার্ডের ঋনগ্রস্ত জয়নাল-লিপি দম্পতি। জয়নাল পেশায় ভারাটে একজন রিকসা চালক। বর্তমানে তার গ্রামীন ব্যাংক থেকে ৪০ হাজার, উদ্দীপন ৪০ হাজার, স্লোভ বাংলাদেশ ৫০হাজার, আশা ব্যাংক ৫০হাজার ও বিআরডিবি থেকে ৪০হাজার টাকাসহ  মোট ঋন নিয়েছেন ২লাখ ২০হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে তার কিস্তি মোট ৫হাজার ৫শ’ টাকা। এ ঋন গ্রহিতা রিকসা চালিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৪শ’ টাকা হিসাবে সপ্তাহে মোট ২ হাজার ৮শ’ টাকা আয় করে। এরমধ্যে চাল-ডাল, পান-সুপাড়িতে খরচ হয় ১হাজার টাকা থেকে ১২শ’ টাকা পর্যন্ত। হাতে থাকে ১৬শ’-১৮শ’ টাকা । রিকসা চালক জয়নাল সপ্তাহের আয়ের সব টাকা দিয়ে কিস্তি দিলেও পরিশোধ হচ্ছে না তার সাপ্তাহিক কিস্তি । পাশ্ববর্তী বাড়ির নিজাম-নয়নতারা দম্পতি। পেশায় ভ্যান চালক। দৈনিক ৭/৮শ’ টাকা হিসাবে সাপ্তাহিক আয় ৪হাজার ৯শ’ থেকে ৫হাজার ৬শ’ টাকা পর্যন্ত ।  বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেয়া তার সাপ্তাহিক কিস্তি দিতে হয় ১০হাজার টাকার অধিক। উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বাশবাড়িয়া গ্রামের নিজাম দরজি-সীমা বেগম   ও গছানী গ্রামের মাহাবুল প্যাদা-হাসিনা বেগম  একাধিক এনজিও থেকে ঋন নিয়েছেন । তাদের আয়ের চেয়ে সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা বেশি হওয়ায় অন্য এনজিও থেকে নতুন করে ঋন নিয়ে পুরাতন ঋনের কিস্তি পরিশোধ করেন। উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে জয়নাল, নিজাম, নিজাম দরজি ও মাহাবুল প্যাদাসহ শত শত শত নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষগুলো ঋনের জালে জড়িয়ে পড়েছে । অপর দিকে ঋনের কিস্তি দিতে না পেরে প্রতিবছর এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছে। গত একমাসে উপজেলা সদরের পারুল বেগম, কুলসুম, তহমিনা,রাবেয়া ও বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের অরুনা বেগম একাধিক এনজিও’র কিস্তি দিতে না পেরে ভিটে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।  এসব নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো একেএকজনে ১০/১২ লাখ টাকা ঋনী বলে জানা যায়।
এ উপজেলায় ৭টি ইউনিয়নে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রায় অর্ধশত এনজিও দারিদ্রো বিমোচনের শ্লোগানে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ঋন বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এছাড়া সরকারের পৃষ্টপোশকতায় যুব উন্নয়ন, বি,আর,ডি,বি, পদাবিক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, সমাজ সেবা, বার্ড, এস এফ ডি পি। এনজিও গুলোর মধ্যে আশা, ব্রাক, সংগ্রাম, উদ্দীপন, পদক্ষেপ, কোষ্ট, স্যাপ ও ভিসিডিএস ওপর গত একসপ্তাহ ধরে জরিপ চালানো হয়। এসব এনজিওদের ব্যাবস্থপকদের সাথে দারিদ্রো বিমোচনের বিষয় কথা বললে তারা বলেন, একজন ঋনী প্রথম ঋন নিয়ে পরিশোধ করে পুনরায় ঋন নিয়ে থাকে। এতেই ওই ঋনী আগের চেয়ে স্বাবলম্ভী হয়েছে বলে তারা মনে করেন। এটাই হলো তাদের দারিদ্রো বিমোচন । এসব এনজিও, ১৫জন থেকে ১০০জনের সদস্য বিশিষ্ট একটি সমিতি করে ঋন কার্যক্রম শুরু করার লক্ষে। ভিলেজ এন্ড সিটি ডেভলপমেন্ট সোসাইটি (ভিসিডিএস) এর কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৭ সালের ১ জুলাই ৭৮জন সদস্য নিয়ে। বর্তমানে তাদের ঋন গৃহিতার সংখ্যা ৬শ” জন। মোট ঋন বিতরন করেছেন মাঠে ৬৩ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৫ টাকা। কোস্টাল এসোস্টিয়েশন ফর সোস্যাল ট্রান্স ফরমেশন ( কোস্ট) এর কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৫ সালের ২৭ জুন ৫০ জন ঋন গ্রহিতা নিয়ে। বর্তমানে তাদের ঋন গ্রহিতার সংখ্যা ১ হাজার ২৬৪ জন। মোট ঋন বিতরন করেছেন মাঠে ১কোটি ৮১ লাখ টাকা । পদক্ষেপ ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর ২০জন সদস্য নিয়ে ক্ষুদ্র ঋন কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে তাদের ঋন গ্রহিতার সংখ্যা ১ হাজার ৬শ’ ১৭জন। মোট ঋন দিয়েছে  ৪কোটি ৩৯লাখ ৭৯হাজার ৪৯০টাকা। ব্রাক এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৫সালে। বর্তমানে তাদের এ উপজেলায় ৩টি শাখা রয়েছে। এ তিন শাখায় ৬ হাজার ঋন গ্রহিতা রয়েছে। প্রায় ১৮কোটি টাকা ঋন দিয়েছেন বলে এরিয়া ম্যানেজার মোঃ ফারুক হোসেন জানান। তাদের আরেকটি ঋন দান শাখা রয়েছে নাম প্রগতি। প্রগতি অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি মুঠোফোনে এরিয়া ম্যানেজার মৃতঞ্জয়ের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, মিডিয়া কর্মীকে কোন তথ্য দেয়া যাবে না কতৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া। আশা এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৪ সালের ১ জান্য়ুারী ৩৫ সদস্য বিশিস্ট সমিতি নিয়ে। বর্তমানে তাদের ৪টি শাখায় মোট ৭ হাজার ঋণ গ্রহিতা রয়েছে। এসব সদস্যর মধ্যে ঋন দেয়া হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। সাউথ এশিয়া পাটর্নারশীপ (স্যাপ) বাংলাদেশ ২০০৪ সালের ৩ নভেম্বর ১শ’ সদস্য নিয়ে ক্ষুদ্র ঋন কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে তাদের ৬শ’ ৭জন ঋন গ্রহিতা রয়েছে। ঋন গ্রহিতাদের মধ্যে তারা ৯৩ লাখ ৪৫ হাজার ২৮৬ টাকা ঋন দিয়েছেন। সংগ্রাম ২০০৬ সালে ৫০ জন সদস্য নিয়ে ক্ষুদ্র ঋন কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে তাদের ৩টি শাখা অফিসে কার্যক্রম চলছে। মোট ঋন গ্রহিতার সংখ্যা ৪ হাজার ৫শ’ জন। মোট ঋন বিতরনের পরিমান ৫৭ কোটি ৬৬ লাখ ৯ হাজার টাকা। উদ্দীপন টিডিএস লিঃ থেকে  ক্রয় করে।  ২০১২ সালের ১ মার্চ ৫শ’ সদস্য নিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তাদের ৪টি শাখা অফিস রয়েছে। দশমিনা সদর অফিসে ১ হাজার ৬শ’ ৯ জন ঋন গ্রহিতার মধ্যে ২৫ কোটি ৮৬ লাখ ১০ হাজার টাকা ঋন দিয়েছে বলে ম্যানেজার গৌতম চন্দ্র জানায়। উপজেলা এনজিও সমন্বয়কারী পিএম রায়হান বাদল বলেন, ঋন নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়াই হল দারিদ্রো বিমোচন। বর্তমান অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে সরকার ও সমাজের বিত্তশালী ব্যাক্তিদের সমন্বয় আর্থিক সহায়তা এবং কর্ম সংস্থান সৃষ্টি করে শ্রমের যথাযথ মূল্যয়ন করলে অধিকাংশ লোক ঋনের বেড়া জাল থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবে । বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সাধারন সম্পাদক মোঃ জায়েদ ইকবাল খান এনজিওদের দারিদ্র্য বিমোচন শ্লোগান কাগজ পত্রেই রয়ে গেছে । তৃনমূল ভূমিহীন যারা এক সময় ঋনগৃস্ত ছিলনা এনজিও ঘরে ঘরে গিয়ে তাদেরকে সু-কৌশলে ঋনী করা হয়েছে। এনজিওরা  দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক কিস্তি টাকা আদায়ে করায় তাদের(ভূমিহীন দুস্ত মানুষ) আরামের ঘুম হারাম হয়েছে। কিস্তি আদায়ের জন্য থানা পুলিশ দিয়ে হয়রানী করা হয় ঋন গ্রহিতাদেরকে। এমন কি স্বামীর ভিটে বাড়ি স্ত্রীর নামে লিখে নেয় এবং ওই নারীকে ঋন দিয়ে বসত ঘরের সামনে ওমুক এনজিওর দায়বদ্ধ সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়। এনজিওরা দারিদ্রো বিমোচন করছেনা বরং তৃনমুল মানুষের রক্ত শোষন করছে।

এসবি/এনইউবি

বাংলাদেশ সময়: ১৫:১২:২৩ ● ৬৫১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ