মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥
বদলে যাবে কুয়াকাটা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুয়াকাটাকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তরে সরকার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সেতুসহ মহাসড়ক নির্মিত হয়েছে। কুয়াকাটার মাস্টারপ্ল্যান চুড়ান্ত করা হয়েছে। চমকে দেয়ার মতো। বিস্ময়কর উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
কুয়াকাটার উন্নয়নে লতাচাপলী মৌজার দশ হাজার দুই শ’ ৭৯ একর জমি নিয়ে সংরক্ষিত জোন করা হয়েছে। পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের খাস জমির দখলদার উচ্ছেদ করার। এসব জমিতে নির্মিত হবে উন্নয়ন কর্মকান্ডের স্থাপনা। সরকারি সুত্র মতে কুয়াকাটায় সরকার নির্মাণ করতে যাচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম। একটি বিশ^বিদ্যালয়। প্লে-গ্রাউন্ড, কনভেনশন সেন্টার। বিমানবন্দর। ওয়াচ টাওয়ার। আধুনিক হাসপাতাল। সুপার মার্কেট। সরকারি আধাসরকারি সকল অফিস। মিউজিয়াম। ফায়ার সার্ভিস। দর্শনীয় শহীদ মিনার, হেলিপ্যাড। চালু করা হবে হিস্টরিক সাইট। নির্মাণ হবে বাসটার্মিনাল, লঞ্চঘাট। বিশেষ মার্কেট। ইকোপার্ক। মৎস্য মার্কেট। মেরিন পার্ক, মেরিন ড্রাইভ, টেনিস পার্ক। এমনকি সাবজেল পর্যন্ত নির্মিত হবে। এতোসব উন্নয়নের যাত্রা শুরু হবে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়।
পর্যটন, গৃহায়ন ও গণপুর্তসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আলীপুর মৎস্যবন্দর থেকে কুয়াকাটাগামী মহাসড়কের তুলাতলী স্পট থেকে একটি ডাবল লেনের উন্নত সড়ক পর্যটন পল্লী গঙ্গামতি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার।
কলাপাড়া থেকে কুয়াকাটা মহাসড়কের ২২ কিমি অংশে তিন নদীতে তিনটি আধুনিক সেতু নির্মিত হয়েছে এক বছরেরও বেশি আগে। ফেরি পারাপারের দূর্ভোগ লাঘব হয়েছে। বর্তমানে কুয়াকাটায় যেতে তিনটি সেতু পার হতে হয়। তারপরও উপজেলা সদর থেকে বিকল্প পথে একটু সেতু পেরিয়ে কুয়াকাটায় যেতে ইতোমধ্যে বালিয়াতলী পয়েন্টে আন্ধারমানিক নদীতে নির্মাণ চলছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর। বর্তমানে সেতুর পাইলের কাজ চলছে। ৮৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয় এ সেতুটি নির্মাণ হচ্ছে। ১৩টি স্প্যানের ওপর ফুটপাথসহ ২৪ দশমিক এক ফুট প্রস্থ হচ্ছে সেতুটি। ৬৭৭ মিটার দীর্ঘ সেতুর রয়েছে দুই পাড়ে পাঁচ শ’ মিটার সংযোগ সড়ক। এ সেতুটি চালু হলে কুয়াকাটা ছাড়াও পায়রা বন্দরের মূল টার্মিনাল চারিপাড়ায় যেতে পারবে পর্যটক-দর্শনার্থীসহ সকল শ্রেণির মানুষ। যেতে পারবেন সহজেই পর্যটন পল্লী গঙ্গামতি। এছাড়া রজপাড়া থেকে পায়রা বন্দরের সঙ্গে নির্মিত ফোর লেন সড়কের গাজীবাড়ি স্পট থেকে একটি সড়ক নির্মিত হচ্ছে বিকল্প সেতুর সংযোগসড়ক পর্যন্ত। প্রায় সাত কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির প্রস্থ থাকছে ২৪ ফুট। এর মধ্যে ১৮ ফুট প্রস্থ কার্পেটিং হবে। এ সংযোগ সড়কটির টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এজন্য ১৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কিছুদিনের মধ্যে এ সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে বলে উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মান্নান জানালেন। এছাড়া পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের জরিপ কাজও শুরু হয়েছে।
পরিকল্পিত নগরায়নের জন্য ইতোমধ্যে কুয়াকাটা পৌরসভা এলাকায় যে কোন ধরনের ভবন নির্মাণে অনুমোদিত নক্সা-ডিজাইন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এসব ডিজাইন নক্সা অনুমোন করলেই ভবন তোলার অনুমতি পাবেন নাগরিকরা। কুয়াকাটা পৌরসভার মধ্যে খালসহ যেসব খাস জমি অবৈধ দখলে রয়েছে তা উদ্ধারে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে খাল দখল করে তোলা পাঁচটি স্থাপনা অপসারনে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
একই স্পটে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়-সুর্যাস্তের মনোলোভা বিরল প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ রয়েছে কুয়াকাটায়। দীর্ঘ পরিচ্ছন্ন সৈকতটির কিনার ঘেঁষা রয়েছে সবুজের সুন্দর আচ্ছাদন। নারিকেল বাগান, ঝাউবিথী। আর পশ্চিম ও পূর্বদিকের প্রান্তে রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আরেক সৌন্দর্যময় স্পট।
সুন্দরের প্রাকৃতিক লীলাভূমি কুয়াকাটাকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্রে উন্নয়নে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ পরিকল্পনা হাতে নেয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সাল থেকে কুয়াকাটাকে পৌরসভায় উন্নীতের পরিকল্পনা সূচিত হয়। যা ২০১০ সালে পুর্ণতা পায়। কুয়াকাটায় আগত পর্যটকসহ স্থানীয় ব্যবসায়ী ও নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানে নৌ-পুলিশ ফাড়ি নির্মিত হয়। কার্যক্রম চালু হয় ট্যুরিস্ট পুলিশের। সবশেষ মহিপুর মৎস্য বন্দরে নির্মিত হয় পুলিশি থানা। ইতোমধ্যে প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে কুয়াকাটায় লগ্নিকারকদের স্থাপনাসহ ভূ-সম্পত্তি এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া সাগরঘেঁষা লতাচাপলী ও ধুলাসার দুই ইউনিয়সহ কুয়াকাটা পৌরএলাকার রক্ষাকবচ ৩৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করেছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আধুনিকভাবে বন্যা কিংবা জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধের মতো করে পুনঃনির্মাণ করা হবে পুরো বাঁধটি। বাঁধটির উচ্চতা দেড় মিটার (পাঁচ ফুট) উচু করা হবে। সম্পুর্ণ বাঁধটির পাদদেশ বর্তমানের চেয়ে আরও ৩৫ ফুট প্রশস্ত করা হবে। বাঁধটি প্রায় ১২০ ফুট প্রস্থ করা হচ্ছে। এছাড়া সিসি ব্লক প্লেসিং করে রিভার সাইটে এক মিটার উচু করলে পাঁচ মিটার স্লোপ থাকছে। একই ভাবে কান্ট্রি সাইটে এক মিটার উচ্চতায় দুই মিটার স্লোপ থাকবে। বাঁধটির আধুনিকায়নের মধ্যে টপে পর্যটকের ভ্রমনের জন্য ওয়াকিং জোন থাকবে। এর পাশে নির্দিষ্ট দুরত্বে থাকবে বড় ধরনের বেঞ্চি টাইপের সিসি ব্লক। যেখানে বসে আগতরা জমিয়ে আড্ডার পাশাপাশি স্বল্পকালীন বিশ্রামও নিতে পারবেন। এক কথায় দীর্ঘ বাঁধটি হবে দৃষ্টিনন্দন। এজন্য বিশ^ ব্যাংক ইতোমধ্যে ১৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। কার্যাদেশও দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ঠিকাদার চরম ঝুকিপূর্ণ চারটি পয়েন্টে জরুরি প্রটেকশন দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরও জানান, শুধু জলোচ্ছ্বাস ঠেকানো উদ্দেশ্য নয়। কুয়াকাটাকে পর্যটকের কাছে আকর্ষনীয় করতে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় এমন মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মোটকথা পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটাকে ঘিরে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। বদলে যাবে কুয়াকাটার চেহারা।
কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আব্দুল বারেক মোল্লা জানান, কুয়াকাটার সামগ্রিক উন্নয়নে মহাপরিকল্পনার কাজ শুরুর দিনক্ষণের সঠিক তথ্য তিনি জানেন না। তবে পৌর এলাকায় শীঘ্রই পানি রিফাইন প্রকল্প যার মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি বাজারজাতকরন এবং ওভার হেড ট্যাংকি স্থাপনের মাধ্যমে পৌরবাসীর পানির সরবরাহের কাজ শুরু হবে। নগরীর স্যানিটেশন উন্নয়নে ১০টি গণ সৌচাগার নির্মাণ এবং ১৩ কিমি ড্রেণ নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। একই সঙ্গে ১২কিমি সড়ক নির্মাণ কাজও হচ্ছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলহাজ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘কুয়াকাটার উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ২০০১ সাল থেকে কাজ শুরু করে বর্তমানে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। যার মধ্যে তিনটি সেতুসহ মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে সকল উন্নয়ন কাজের বাস্তবায়ন চলছে।’
এমইউএম/এমআর