মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥
সাগরপাড়ের জনপদ কলাপাড়ায় বিগত দশ বছরে কৃষি জমি কমেছে প্রায় ১৫ হাজার একর। কিন্তু কমেনি, বেড়েছে ৩২ হাজার মেট্রিক টন ধানের উৎপাদন। যেখানে ২০০৮ সালে আমন ধানের উৎপাদন ছিল এক লাখ চার হাজার ৭২০ মেট্রিক টন। সেখানে ২০১৮ সালে ধানের ফলন হয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন।
উফশী জাতের ধানের আবাদ ২০০৮ সালে হয়েছে ২০ হাজার ৩০৩ একর জমিতে। সেখানে ২০১৮ সালে উফশি জাতের ধানের আবাদ হয়েছে ৫৯ হাজার ৫২৭ একর জমিতে। বেড়েছে উফশীর আবাদ বেড়েছে ৩৯ হাজার একর জমিতে। জমি কমলেও কৃষকরা উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের আবাদ বাড়িয়ে কৃষক ধানের ফলন বৃদ্ধি করেছে। জমি কমলেও এর প্রভাব পড়েনি উৎপাদনে। কৃষকরা উদ্যমী হয়ে প্রশিক্ষিতভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে এ জনপদে খাদ্যউৎপাদনের অগ্রগতি ধরে রেখেছেন। তারপরও পরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর, উন্নয়ন কর্মের জন্য দুই এবং তিন ফসলি কৃষি জমি ব্যবহারের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার দাবি করেছেন কৃষকরা। খাদ্যে উদ্ধৃত্ত এ জনপদে এখনও ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন সাগরপারের চাষীরা। সরেজমিন অনুসন্ধান করে কৃষিতে বিপ্লবের এ দৃশ্য উঠে এসেছে।
বিস্ময়কর উন্নয়নের জনপদ সাগরপাড়ের কলাপাড়া। যেখানে এখন কর্মমুখর পায়রা সমুদ্র বন্দর। পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র চালুর অপেক্ষায়। আরও একাধিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। চলমান রয়েছে শের-ই-বাংলা নৌঘাটি। এসব উন্নয়ন কর্মে প্রায় সাত হাজার একর কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এসব জমির প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। করা হচ্ছে সাতটি পুনর্বাসন পল্লী। এসব কারনে ফসলী জমি কমেছে। এছাড়া পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার উন্নয়নে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন কর্ম চলছে এগিয়ে। আবাসন আগ্রাসনসহ অপরিকল্পিতভাবে দেদার বাড়িঘর নির্মাণের কারণে কৃষিজমি কমছে দ্রুত। গত দশ বছরে অন্তত ১৫ হাজার একর কৃষি জমি কমেছে এই জনপদের। এসব সমস্যার পাশাপাশি কৃষিকাজে ব্যবহারের খাল-বিল, জলাশয় দখল ভরাট হয়েছে বিপুল সংখ্যক। তারপরও এ জনপদে কৃষি উৎপাদন কমেনি। লবণসহিষ্ণু জাতের ধানসহ সবজির আবাদ বেড়েছে। বেড়েছে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের আবাদ। কৃষকরা আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদে ঝুকেছেন। এক ফসলী কৃষি জমি পরিণত হচ্ছ দুই-তিন ফসলী জমিতে। যেন কৃষিতেও বিপ্লব হয়েছে গেল ১০ বছরে। কৃষকরা হয়েছে আরও উদ্যমি এবং কৌশলী। খাদ্যে উদ্ধৃত্ত এই জনপদের ঐতিহ্য যেন আরও স্থায়ীভাবে কৃষকরা ধরে রেখেছেন। কৃষিবিভাগও নতুন নতুন ধান, রবিশস্যসহ সবজির আবাদের কৌশল শেখাচ্ছেন। কৃষকরাও লাভের মুখ দেখতে পারছে। তাই তাঁরা এ পেশায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। ধানের পাশাপাশি সবজি এবং ফলদ জাতের গাছের বাগান করছেন। ১২ মাস কোন না কোন ফসল উৎপাদন করছেন কৃষকরা।
সরেজমিনে অনুসন্ধান জানা যায় এ জনপদে কৃষি বিপ্লবের গল্প। কুয়াকাটাগামী মহাসড়ক লাগোয়া বাড়ি ইসলামপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল গণি মোল্লা। বয়স ৭৪ বছর। শরীরের কাঠামো এখনও ধরে রেখেছেন। জানালেন তিনি, ২০০৮ সালের আগে এক কানি (৮ বিঘা) জমিতে সর্বোচ্চ ধানের ফলন পেতেন ৭০-৭৫ মণ। আর এখন কমপক্ষে ১০০-১২০ মণ। প্রথমে উফশী জাতের ধান বাড়িতে নিয়ে আসেন কৃষি কর্মকর্তা। সঙ্গে প্রয়াত চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মুন্সি ছিলেন। তখন বলে-কয়ে আবাদ করাতে রাজি করছিলেন তাকে। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের ধানের আবাদ শুরু করেন। এর আগে একটি মাত্র ফসল ছিল, আমন। আর এখন অন্ততপক্ষে দুইটি ফলন ফলাচ্ছেন। আগে এলোপাথারি ধানের চারা রোপন করতেন। আর এখন সারিবদ্ধভাবে রোপন করেন। জানালেন এ বয়োবৃদ্ধ মানুষটি, পুকুরের পানি সেচ দিয়ে বোরোর আবাদ শুরু করেছিলেন। এখন, এবছর তিনি উফশী ব্রি-৭৬,৭৭ জাতের আবাদ করেছেন। কলাপাড়া, বরগুনা, মানিকগঞ্জের শিবালয় গিয়ে অসংখ্য প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। গল গল করে কলাপাড়ায় কর্মরত অন্তত সাতজন কৃষিকর্মকর্তার নাম বললেন মানুষটি। আর উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা তো এ মানুষটির ছেলেদের মতো বাড়িঘরে যায়। গোটা বাড়িতে আম, তেতুল, তাল, কুল, আপেল, মালটাসহ অসংখ্য ফলদ গাছে পরিপূর্ণ করেছেন। গণি মোল্লা এখনও শক্ত, সুঠাম দেহের অধিকারী। মেঝো ভাই শামসুল হক মোল্লা, ছোট ছিদ্দিক মোল্লা সবাই পরিপূর্ণ কৃষক পরিবার। অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক সমৃদ্ধ গণি মোল্লার। জানালেন এখন কৃষকরা মিঠা পানি পেলে বছরে আমন, বোরো ও আউশ তিনটি ফসল ফলাতে পারতেন। তার পরামর্শ খাল ও স্লুইস গেটের নিয়ন্ত্রণ প্রকৃত কৃষকের হাতে থাকতে হবেই। পাশাপাশি ধানের ন্যায্যমূল্য থাকা খুবই জরুরি বলে মনে করেন এ কৃষক। তার দাবি এখন এক কানি ৮ বিঘা জমি চাষাবাদে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। সেখানে ১২০ মণ ধান বিক্রি করতে হয় ৬০০ টাকা দরে মাত্র ৭২ হাজার টাকা। প্রান্তিক কিংবা বর্গা চাষীরা ধান চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফলদ জাতের বাগান কিংবা সবজির আবাদে ঝুকছে। এতে ধানের চেয়ে দ্বিগুন লাভ হয়। গণি মোল্লার মন্তব্য, দিনের পর দিন বাড়িঘর বাড়ছে। রাস্তাঘাট বানানো হচ্ছে। চাষের জমি কমছে। কিন্তু কৃষকরা উফশী জাতের ধান আবাদ করায় ফলন কমেনি।
নীলগঞ্জের কুমিরমারা গ্রামের সফল চাষী সুলতান গাজী (৬২)। দুপুরে সবজিক্ষেতে কাজ করছিলেন। জানালেন তিনি, এ বছর আট বিঘা জমির সবটায় উফশী জাতের (বিআর-১১) ধানের আবাদ করেছেন। কমপক্ষে এক শ’ মণ ফলন পাওয়ার আশাব্যক্ত করলেন এ চাষী। সুলতান গাজী আরও বললেন, গেল বছর আমন ছাড়াও ছয় বিঘা জমিতে হাইব্রিডের আবাদ করে এক শ’ মণ ধান পেয়েছেন। দেড় একর জমিতে সবজির আবাদ করেছেন। ক্ষেতেই ১২ মাস। জীবন-জীবিকায় যেন স্বস্তির ছাপ ফুটে আছে মানুষটির চোখে-মুখে। মানুষটির ভাষ্য, ‘মুই ২০০৮ সালে উফশি ধানের আবাদ শুরু করি। আর থামি নাই। এর আগে কানি (৮বিঘা) জমিতে সর্বোচ্চ ৪০/৪৫ মণ ধান পাইতাম।’ সাফ কথা সুলতান গাজীর, কৃষি জমি কমছে কিন্তু উফশী জাতের আবাদের কারণে ফলন বাড়ছে। মিঠা পানির সমস্যা সমাধান করতে স্লুইস সংযুক্ত খালের নিয়ন্ত্রণ কৃষকের কাছে দেয়ার দাবি এ কৃষকের। ৩৫ হাজার কৃষক পরিবারের এখন প্রধান দাবি এমনটি।
কৃষি অফিস কলাপাড়ার দেয়া তথ্যমতে, ২০০৮ সালে কলাপাড়ায় উফশি জাতের ধানের আবাদ হয় মাত্র ২০ হাজার ৩০৩ একর জমিতে। ফলন হয় ২৮ হাজার ৭৭০ মেট্রিক টন। আর ২০১৩-২০১৪ সালে উফশী ধানের আবাদ হয় ৪৬ হাজার ৫৫৯ একর জমিতে। ফলন হয় ৭৫ হাজার চার শ’ মেট্রিক টন। এখন ২০১৮-২০১৯ সালে আবাদ হয়েছে উফশী জাতের ৫৯ হাজার ৫২৭ একর জমিতে। আর ফলন হয়েছে এক লাখ আট হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন। অথচ উল্টোচিত্র চাষাবাদের জমির হিসেবে। ২০০৮ সালে স্থানীয় জাতসহ মোট আবাদি কৃষি জমি ছিল ৯৫ হাজার ৩৪২ একর। আর এখন ২০১৮ সালে কমে চাষের জমির পরিমাণ হয়েছে ৮৫ হাজার ২১৫ একর। সরকারী হিসেবে কলাপাড়ায় চাষের জমি কমেছে ১০ হাজার ২১৭ একর। যেখানে ফলন কমার কথা ৪০ হাজার মেট্রিক টন। উল্টো ফলন বেড়েছে অন্তত ৩২ হাজার মেট্রিক টন। সরকারি হিসেব এটি হলেও বেসরকারি হিসেবে কৃষি জমি কমেছে অন্তত ১৫ হাজার একর। কলাপাড়ায় বর্তমানে সরকারি হিসেবে দুই লাখ ৪৯ হাজার ৩৮৮ জন মানুষের জন্য খাদ্য চাহিদা ৪০ হাজার ২৩৪ মেট্রিক টন চাল। যেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৭৯ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন চাল। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল মান্নান জানান, এরপরও কৃষকের কৃষিকাজের সুবিধার্থে বেড়িবাঁধ মেরামত করা, স্লুইস ও কালভার্ট মেরামত, হাজামজা খাল খনন করা, লবণাক্ততা সহনশীল বোরো ধানের আবাদ আরও বৃদ্ধি করা, ডাল, তেল ও মসলা জাতীয় ফসলের আবাদ বাড়ানো, কৃষককে পাওয়া পাম্প ক্রয়ে উৎসাহিত করা, জৈবসার উৎপাদন ও ব্যবহারে কৃষককে উদ্ধুদ্ধ করা, আমন ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে জমি চাষ দিয়ে জো ধরে রাখা, উন্নতমানের বীজ ব্যবহারে উদ্ধুদ্ধ করা, সুসম হারে সার ব্যবহারে সচেতন করা, ব্লক পর্যায়ে কৃষককে উদ্ধুদ্ধ করা প্রয়োজনসহ কৃষককে আরও বেশি প্রশিক্ষিত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এসব কর্মকান্ড করতে পারলে উৎপাদন আরও বাড়বে পাশাপাশি কৃষক এ পেশাকে লাভজনক পর্যায়ে ধরে রাখতে সক্ষম হবে। তাই উন্নয়ন কর্ম ছাড়াও আবাসন আগ্রাসনে এই জনপদের কৃষি জমি কমলেও উন্নত জাতের ধানের আবাদের কারণে ফলন বেড়েছে কয়েকগুন। এই ধারা ধরে রাখতে কৃষকদের সমস্যার সমাধান করতে হবে আগে এমন দাবি সাগরপাড়ের কলাপাড়ার কৃষককূলের।
এমইউএম/এমআর