কামরুল হাসান, রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী) থেকে॥
শেষ বয়সে তাকে দেখার কেউই নেই। মাথা গোঁজার ঠিকানা ছোট একটি গোয়ালঘর। সেটিতে গবাদিপশুর বর্জ্যরে এতোই দুর্গন্ধ যে, দুর্বিসহ অবস্থা। তবুও নিরুপায় হয়ে সেখাইনেই বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। এই কনকনে শীতে স্যাঁতসেতে মেঝেতে বেছানো একটি শীতল পাটিই তার বিছানা সেখানে। রোগা শরীর নিয়ে কোনমতে একবেলা রাঁধেন, চার-পাঁচ বেলা খান। প্রায় বেলাতেই পান্তা ভাত আর পোড়া মরিচ জোটে কপালে। কখনো কখনো না খেয়েও দিন পার করতে হচ্ছে।
মানবেতর জীবন যাপনের এই গল্প ৭২ বছরের বৃদ্ধা নূরজাহান বিবির। তিনি পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের মৌডুবির খাসমহল গ্রামে বসবাস করেন। কিন্তু সেখানে তার ভিটেবাড়ি কিছুই নেই। নিকটত্মীয় বলতে এক মেয়ে ছাড়া কেউই নেই তার। দারিদ্র্যতা ও অসহায়ত্বের কারণে সেই মেয়ের পক্ষেও মায়ের খোঁজ রাখা সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই তাকে দেখবার মত কেউই নেই এখন। বয়সের ভাড়ে হাটাচলা নূরজাহানের পক্ষে কষ্টসাধ্য। তবুও রোগা শরীর নিয়ে তাকে গ্রামে বের হতে হয়। পেটের তাগিদে লাঠিভর দিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে হয়। হাত পেতে যায় পায়, তা দিয়েই চালান রান্নাবান্না। কিন্তু যেইদিন শরীর-স্বাস্থ্য ভাল থাকে না, সেইদিন নূরজাহান গ্রামেও বের হতে পারেন না। তাই সেদিন রসাইও বন্ধ, জোটেনা তার কপালে দু’মোঠো খাবার। এভাবেই কষ্টে দিন পার করছেন নূরজাহান। সরেজমিনে গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
দেখা গেছে, খাসমহল গ্রামে ছয় হাত দৈর্ঘ্য আর পাঁচ হাত পস্থের একটি গোয়ালঘরে বাস করছেন বৃদ্ধা নূরজাহান। সেখানে এলোমেলো পুরনো কাপড়-চোপড়। এককোনে চুলা, আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাড়ি-পাতিল। এসব নিয়েই তার একাকি সংসার। কষ্টের জীবনের কথা জানতে চাইলে অশ্রুভেজা চোখে নূরজাহান বিবি যুগান্তর প্রতিবেদকে বলেন, ‘বাবারে খুব কষ্ট করি। এই শীতে থাহা (থাকা) যায় না। রাইতে (রাতে) বাতাসে গাও, আত (হাঁত) ও পাও ঠান্ডা ওইয়া যায়। থড়থড় কইর্যা কাঁপি। অসুখবিসুখ লইয়া বাড়ি বাড়ি যাইতে পারি না। টাহার অভাবে ওষুধ (ঔষধ) কিনতে পারি না। বোলাইলে (ডাকলে) কেউ আয়ও না। নিজে রান্ধি যা, হেইয়াই খাই। এই জীবন আর ভাল লাগে নারে বাবা।’ মায়ের এমন হীন অবস্থার বিষয়ে মেয়ে মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমি পরের সংসার করি। বোঝেনতো, ইচ্ছা করলেই মাকে নিয়া রাখতে পারি না। আমি সংসারের কাজকাম কইরা মাঝেমাঝে আইয়া মা’র কাজকাম করে দেই।’
স্থানীয়রা জানায়, ২০০৬ সালে অর্থাৎ ১৩ বছর আগে নূরজাহানের স্বামী আছমত হাওলাদার মারা যান। আছে শুধু মমতাজ নামের এক মেয়ে। খাসমহল গ্রামের বেল্লাল হোসেনের সঙ্গে মমতাজের বিয়ে হয়। তবে মা-মেয়ের একই গ্রামে থাকা হলেও সংসারের অভাব-অনটন, দারিদ্র্যতা ও স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করায় মায়ের খোঁজখবর নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না মমতাজের। একারণে স্বামীর মৃত্যুর পর একাকিত্ব জীবন নিয়ে অসহায় হয়ে পরেন নূরজাহান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বামী মৃত্যুর পরই কারও না কারও সহানুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে নূরজাহানকে। দেড় বছর ধরে প্রতিবেশী মর্জিনা বেগমের বাড়িতে আশ্রয়ে ছিলেন নূরজাহান। কিন্তু রোগবালাইর কারণে আর বেশিদিন ঠাঁই হয়নি সেখানে। সর্বশেষ প্রতিবেশী জহিরুল পঞ্চায়েতের গোয়ালঘরে ঠাঁই হয় তার। প্রায় দুই মাস ধরে সেখানে তিনি মানবেতর জীবন যাপন করছেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আসলেই নূরজাহান বিবি খুব মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাকে একটি সরকারি ঘর দেওয়ার দাবি জানাই সরকারের কাছে।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান একটি পত্রিকার অনলাই ভার্সনের কথা উল্লেখ করে সাগরকন্যাকে বলেন, বৃদ্ধ নূরজাহান বেগমের মানবেতর জীবন যাপনের সংবাদটি প্রকাশিত হলে বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক মহোদয় বিষয়টি অবহিত হয়েছেন। আমাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ওই বৃদ্ধ মহিলাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার। আমি সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করছি।