পায়রায় ক্ষতিগ্রস্থ নর-নারীরা এখন স্বপ্ন দেখছে আত্মনির্ভরশীলতার

প্রথম পাতা » বিবিধ » পায়রায় ক্ষতিগ্রস্থ নর-নারীরা এখন স্বপ্ন দেখছে আত্মনির্ভরশীলতার
শনিবার ● ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯


পায়রায় ক্ষতিগ্রস্থ নর-নারীরা এখন স্বপ্ন দেখছে আত্মনির্ভরশীলতার

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া সাগরকন্যা অফিস॥

পায়রা বন্দর নির্মাণে যেন বদলে যাচ্ছে জমিহারাদের দিন। আর্থিক অনটন থেকে উঠে আসছেন এসব মানুষ। পেশায় লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। হাইলা-কামলা, জেলে পরিবারের কোন না কোন সদস্য নিজেকে গড়ে তুলেছেন প্রশিক্ষিত একজন কর্মদক্ষ জনশক্তিতে।
এরই একজন তাসলিমা বেগম। যেন দিন বদলের লড়াইয়ে সাফল্যের সোনালী সময় পার করছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার দৌড়ে সফল। রঙিন স্বপ্ন্ েবিভোর এই আত্মপ্রত্যয়ী নারী হাঁস পালনের মধ্য দিয়ে জীবন-সংসারে হাসি ফোটাচ্ছেন। সফলতাও হাতছানি দিয়েছে তার জীবনে। এখন দৈনিক কমপক্ষে দেড় হাজার টাকার ডিম বিক্রি করছেন। স্বামী হেলাল ফকির দোকানি। ছেলে নাইম সপ্তম শ্রেণিতে এবং মেয়ে নাদিয়া ক্লাশ টুতে পড়ছে। বাড়িঘর জমিজমা যা ছিল সবটুকু পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করেছে। প্রথমে ভড়কে গিয়েছিলেন। এখন হতাশার জীবনে স্বস্তির নিঃশ^াস নিচ্ছেন এ নারী। স্বামীকে নিয়ে জীবন সংসারকে আর্থিক সাফল্যের কাছাকাছি টেনে নিয়েছেন। হাঁটছেন সাফল্যের পথে। সরকার পায়রায় অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত ৪২০০ পরিবারকে গৃহপুনর্বাসন ছাড়াও কর্মদক্ষতার উন্নয়নে শুরু করা বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষণে অন্যসকলের সঙ্গে হাঁস পালনের প্রশিক্ষণ দেন তাসলিমা বেগম। সফল প্রশিক্ষণের পুরষ্কার বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে ভাতা ছাড়াও পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। তাই দিয়ে যাত্রা শুরু। আট মাস আগে শুরু করেন হাঁসের খামার। পরিকল্পিতভাবে হাঁস পালন শুরু করেন। ১৮ দিনের ওই প্রশিক্ষণে হাঁস পালন পদ্ধতি রপ্ত করেন অদম্য এ নারী। খামারের পরিধি বাড়াতে সোনালী ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে চার শ’ হাসের বাচ্চা কিনেন। প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। হাঁসের ঘর, জালের বেড়াসহ এক দফা খাবার কিনতে। এখন গড়ে ফি-দিন এক থেকে দেড় শ’ হাসের ডিম পাচ্ছেন তাসলিমা। বাড়ি থেকেই পাইকার ১০টাকা করে ডিম কিনে নেয়। আগে ২৮০/২৯০ টি ডিম পেতেনে। কিন্তু বিধি কিছুটা হলেও বাম। ঘর্ণিঝড় বুলবুলের রাতে জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা হাঁসের ঘরে লাগে, এতে ভয় পেয়ে ১৫৫টি হাঁস মারা গেছে তাসলিমার। তারপরও থেমে নেই। দৈনিক দুই বস্তা খাবারসহ নিজের পরিশ্রম নিয়ে গড়ে দৈনিক হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। তারপরও মাসে কমপক্ষে ১৫হাজার টাকা লাভ হচ্ছে। এছাড়া হাঁসের দামতো পুঁজি হিসেবে পড়ে আছে। এ নারী এখন প্রচন্ড আত্মপ্রত্যয়ী, স্বামী সংসার নিয়ে স্বাচ্ছন্দেই দিন পার করছেন। বাড়ি-ঘরের ক্ষতিপুরনের টাকা পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার পেয়েছেন। তবে জমির টাকা পায়নি। প্রশিক্ষণের আগেও সাধারণ এ গৃহিনী সংসারের যোগান দিতেন। আর এখন উপার্জনের প্রধান ব্যক্তি হয়ে আছেন। দক্ষতার উন্নয়নের একটি প্রশিক্ষন এ নারী যেন স্বপ্ন দেখছেন জীবনের সফলতার। মাঝে-মধ্যে হাঁসও বিক্রি করেন। আড়াই শ’ হাঁসের মধ্যে ১০টি হাঁসা রেখেছেন। টানা তিন মাস ডিম দিচ্ছে হাঁসগুলো। অন্তত ৫০ হাজার টাকা আয় করেছেন তাসলিমা। এ যেন প্রশিক্ষণের শেখা। এ নারী এখন উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের কলাউপাড়া গ্রামের মডেল হয়ে আছেন।
শুধু একজন তাসলিমা নন। একই গ্রামের শাহেদা বেগম। আরেক গৃহিনী। পায়রায় জমিহারা। ক্ষতিপুরনের ঘরের টাকা পেয়েছেন। মুরগী ককরেল পারিবারিকভাবে, পরিকল্পিতভাবে পালনের প্রশিক্ষন নিয়েছেন। এখন বাড়িতে একদিন বয়সী সোনালী ককরেল বাচ্চা প্রথম দফায় ২৪ টাকা করে ২৫০ বাচ্চা কিনেছিলেন। আড়াই মাস পরে এক কেজি ৩০০ গ্রাম ওজন অবস্থায় বিক্রি করে দিয়েছেন। ওষুধ, খাবার কেনাসহ সকল খরচ মিলে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। বিক্রি করেছেন ৪৭ হাজার টাকা। দ্বিতীয় দফায় এবারে ৫০০ বাচ্চা কিনেছেন ৪২ টাকা করে। শুধু ভাবনায় ককরেল মুরগী পালন এ নারীর। স্বামী গফুর হাওলাদারসহ সংসারের সবাইকে নিয়ে নতুন জীবিকায় জয়ের লড়াই করছেন এ নারী। ঘরের ক্ষতিপুরনের পাওয়া পর্যাপ্ত টাকা একটি ব্যাংকে রেখেছেন। জমি হারা হলেও জীবন-জীবিকায় নতুন ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন এ নারী। অদম্য উদ্যম নিয়ে কাজ করছেন। সংসারে নেই কোন উৎকন্ঠা। এখন অপেক্ষা কুষিজমির টাকা বুঝে পেয়ে পুনর্বাসনের ঘরটিতে চলে যাওয়া। ৪১ হাজার টাকা খরচ করে শুরু করা আরেক আত্মপ্রত্যয়ী নারী হালিমা বেগম ও মহসিন প্যাদা দম্পতি। হালিমা ককরেল মুরগী পালনের প্রশিক্ষন পেয়েছেন। ৩০০ মুরগির বাচ্চা কিনে শুরু করেছেন। স্বামী দিনমজুরি করলেও দশ জনের সংসারে সুখের স্বপ্ন দেখছেন এ নারী। আরেক অদম্য নারী জাহিদা বেগম। স্বামী ছিদ্দিক মিয়া, তিন সন্তান নিয়ে পাঁচ জনের সংসারে অনাবিল সুখ না থাকলেও নেই অস্বস্তি। ৫৫ হাজার টাকা খরচ করে শুরু করেছিলেন ২৫০ ককরেল মুরগীর বাচ্চা পালন। প্রথম দফায় ৪৮ হাজার টাকা বিক্রি করেন। দ্বিতীয় দফায় ৪০০ বাচ্চা মুরগী কিনেছেন। আড়াই মাস পালন করে বিক্রি করে ১৪ হাজার টাকা লাভ করেছেন। এরা এখন পেছনে তাকাতে রাজি নন। শুধুই সামনে এগিয়ে চলার দিন এদের। সাফল্য এঁদের হাঁতছানি দিচ্ছে। পায়রায় ক্ষতিগ্রস্ত এ নারী প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। প্রশিক্ষিত এসব মানুষ প্রত্যেকে একেকজন এখন দক্ষ কর্মসম্পন্ন মানুষ।
বানাতিপাড়ার মনির হোসেন। রাজ যোগালের কাম করতেন। ২৫০ টাকা দৈনিক মজুরি পেতেন। পায়রা বন্দর কতৃপক্ষের দেয়া তিন মাসের প্রশিক্ষণে এখন প্রশিক্ষিত রাজমিস্ত্রি। দৈনিক আয় করছেন ৭৫০ টাকা।  এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে খেয়ে পড়ে ভালই আছেন। সনদও জুটেছে প্রশিক্ষিত হওয়ার। পুনর্বাসনের ঘরটি পেলেই উঠে যাবেন সেখানে। একই গ্রামের মুসা মৃধা গাড়ি ড্রাইভিংএর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এখন কাজ খুজছেন। যদিও ভাড়াটে হোন্ডা চালাচ্ছেন। বাড়ি-ঘরের ক্ষতিপুরনের পর্যাপ্ত টাকা তুলে রেখেছেন। নতুন বাড়ি করছেন। পুনর্বাসনের ঘর তো পাবেনই। রিয়ামনি একটি কেজি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। এখন অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং বানাতিবাজারের ট্রেলার অফিসার হিসাবে ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছেন। এ তরুনী গৃহবধুর বাড়ি মহল্লাপাড়া গ্রামে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য হিসেব পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে দেয়া বেসিক কম্পিউটারের দুই দফায় ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সনদ পেয়ে এখন প্রশিক্ষিত কর্মী হয়েছেন। মাস্টার্সে পড়ছেন এ গৃহবধূ। বেকার জীবনে নেই। স্বামী মিজানুর রহমান একজন দোকানি। রয়েছে সুখের সংসার।
শুধু লেখাপড়া করতেন হারুন-অর-রশীদ। লেখাপড়ার পাশাপাশি কৃষিকাজ করতেন। বেসিক কম্পিউটারের ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষ করে এখন দক্ষ অপারেটর হিসেবে বানাতিবাজারে কম্পিউটারসহ ফটোকপির দোকান দিয়ে বসেছেন এ যুবক। পলিটেকনিকে পড়ছেন। পাশাপাশি দোকান সামলে চলছেন। এখন একজন দক্ষ কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে দোকান চালাচ্ছেন। সফল মনে করছেন নিজেকে।
প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় পায়রা বন্দরে ক্ষতিগ্রস্ত জমিহারা প্রত্যেক পরিবারকে গৃহপুনর্বাসনের কাজের পাশাপাশি ৪২০০ পরিবার থেকে একজনকে করে কর্মদক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার। তারই ধারাবাহিকতায় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ডেপেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পূয়র (ডরপ) ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে ১০টি ট্রেডে ১১৩৪ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। পরবর্তীতে এ বছরের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বেসিক কম্পিউটার, গাড়ী চালক, রাজমিস্ত্রিী, পোষাক তৈরি, ওয়েল্ডিং, ছাগল পালন, গরু মোটা তাজাকরন, ব্রয়লার ককরেল ও টার্কি পালন, মৎস্য চাষ ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মৎস্য আহরন, উন্নত প্রযুক্তিতে হাঁস-মুরগী পালন ও হাঁস মুরগীর খাদ্য তৈরি, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার পূর্বক পারিবারিক পরিমন্ডলে গাভী পালন ট্রেডে ২৬টি ব্যাচে মোট ৬৬৬ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। যার মধ্যে চলতি মাসে এ পর্যন্ত ১৫০ জনকে প্রশিক্ষন সম্পন্ন করা হয়েছে। রবিবার গিয়ে দেখা গেছে দুই ব্যাচে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ৫০ জন বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষন দিচ্ছে। ডরপ এর টিম লিডার জেবা আফরোজ জানান, বর্তমানে লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদ, ধানখালী ইউনিয়ন পরিষদ, কেআইআইটি ও মাল্টি পারপাস বিল্ডিং, পায়রা বন্দর, কলাপাড়া ও পটুয়াখালীতে প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। ৬ মাস, ৩ মাস, এক মাস, ২১ দিন মেয়াদি প্রশিক্ষণ বিভিন্ন ট্রেডের প্রশিক্ষণগুলো দক্ষ প্রশিক্ষক দিয়ে প্রশিক্ষনার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন এম. মুনিরুজ্জামান জানান, সরকার পায়রা বন্দর নির্মাাণের ফলে ভূমি ও গৃহ অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসনের পর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে সব পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান যাতে ব্যাহত না হয়, তারা যাতে উন্নত জীবন যাপন করতে পারে সে জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের পথ তৈরি করতে তাদের বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদাান করা হয়। প্রশিক্ষণের পরে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পাচ্ছে। তারা ব্যবসা করে জীবন মানের উন্নয়ন করতে শুরু করেছে। প্রশিক্ষনের পর তাদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ কাজে প্রশিক্ষণ পরবর্তী মমনিটরিংও চলছে। এসব পদক্ষেপে এখন পায়রা বন্দওে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে এক ধরনের উদ্যমি মানসিকতা তৈরি হয়েছে স্বাবলম্বী হওয়ার। তারা এখন রয়েছেন হাসি-খুশি।

এমইউএম/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২২:৫১:২৪ ● ৩৩৫ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ