বানারীপাড়া সাগরকন্যা প্রতিনিধি॥
বানারীপাড়ায় কুয়েত প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের বাড়িতে বৃদ্ধা মা মরিয়ম বেগম ও বোন জামাই শফিকুল আলম সহ তিন জনকে হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী মিসকাত জাহান মিশুর জড়িত থাকার প্রমান পেয়েছে পুলিশ। অপরদিকে প্রবাসীর বাড়িতে তিন জন হত্যার ঘটনায় জড়িতদের ফাসির দাবীতে স্থানীয় বাসিন্দারা পৌর শহরে মানববন্ধন করেছে।
সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় তারা পৌর শহরের বাস স্ট্যান্ডে এ মানব বন্ধন করেন। এ বিষয়ে পুলিশ, র্যাব-৮ ও স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রাতে পূর্ব সলিয়াবাকপুর গ্রামের ৫নং ওয়ার্ডের কুয়েত প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের বাড়িতে তিন খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ এক সময়ের নির্মান শ্রমিক ও এলাকায় জারফুক দেয়া জিনের বাদশা জাকির হোসেন এবং তার সহযোগী জুয়েল হাওলাদারকে গ্রেফতার করেন। এসময় তারা পুলিশ কর্মকর্তা ও র্যাব-৮ এর জিজ্ঞাসাবাদে ওই হত্যা কান্ডের বিষয়ে কুয়েত প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের স্ত্রী মিসকাত জাহান মিশু’র জড়িত থাকার অভিযোগ আনেন। এ সময় আটক জাকির হোসেন ও জুয়েল এ ব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তা ও র্যাব-৮ এর কাছে শিকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে তারা এ বিষয়ে আদালতেও শিকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেয় । ওসি শিশির কুমরি জানান, আটক আসামী জাকির হোসেন ও তার সহযোগী জুয়েল তাদের কাছে জানান, প্রবাসীর স্ত্রী মিশুর সহায়তায় তারা তিন জনকে খুন করেছেন। এ ঘটনায় প্রবাসী আব্দুর রবের স্ত্রী মিসকাত জাহান মিশুই তাদেরকে সহায়তা করেছেন বলেও তারা শিকারোক্তি দেন। তাদের শিকারোক্তি অনুযায়ী রোববার দুপুরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি শিশির কুমার পাল এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য কুয়েত প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের স্ত্রী মিসকাত জাহান মিশু ও তার ভাতিজী চাখার সরকালী ফজলু হক কলেজের এইচ.এস.সি প্রথম বর্ষের ছাত্রী আছিয়া খাতুনকে থানায় ডেকে আনেন। সেখানে তাদেরকে বরিশালের উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদে তারা তিন খুনের ঘটনায় প্রবাসী আব্দুর রবের স্ত্রী মিসকাত জাহান মিশুর সংশ্লীষ্টতা পান। পরে তারা মিশুকে আটক রেখে প্রবাসীর ভাতিজী আছিয়া খাতুনকে ছেড়ে দেয়।
এ ব্যাপারে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওসি শিশির কুমার পাল এ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, রোববার দুপুরে আটক তিন জনকে কোর্ট হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়াও তিন খুনের ঘটনায় আরো ব্যাপক তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য পরবর্তীতে আসামীদের বিরুদ্ধে আদালতে রিমান্ড চাইবেন বলে জানান।
এদিকে প্রবাসির বাড়িতে তিন খুনের ঘটানার রাতে বৃদ্ধা দাদী মরিয়ম বেগমের পাশে ঘুমিয়ে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী কলেজ ছাত্রী আছিয়া খাতুন জানান, ঘটনার দিন মধ্য রাতে জিনের বাদশা জাকির হোসেন ও তার কাকী মিসকাত জাহান মিতু তার হাতে কোরআন শরিফ দিয়ে সফত করানোর কারণে এবং তাকে জানে মেরে ফেলার ভয়ে দেখানোর কারণে সে কারও কাছে এব্যাপারে মূখ খুলতে সাহস পায়নি বলে দাবী করে আসলেও রোববার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শিশির কুমার পাল সহ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে সে মূখ খুলেছেন। সোমবার বিকেলে কলেজ ছাত্রী আছিয়া খাতুন এ ব্যাপারে বলেন, আসামী জাকির হোসেন প্রায় দু’বছর আগে থেকেই তাদের বাড়িতে তার চাচা কুয়েত প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের বাস ভবন নির্মানের কাজ করেন। ওই সময় সে তার বৃদ্ধা দাদী মরিয়ম বেগমকে মামী বলে ডাকতেন। সেই সুবাদে তার চাচা আব্দুর রব ও কাকী মিসকাত জাহান মিশুর সাথে তার ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দীর্ঘ দিন ধরে বাড়িতে ভবন নির্মাণের কাজ করার সুবাদে তার কাকী জাকির হোসেনকে মামা বলে ডাকতেন। সেই সুবাদে জাকির হোসেন প্রায়ই তাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন এবং সে নিজেকে জিনের বাদশা দাবী করে রাতে বাড়িতে পরি হাজির করে সকল সমস্যার সমাধান করতে পারেন বলে জানান।
সম্প্রতি তার চাচা প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের একটি মোবাইল ফোন চুরি হয়ে গেলে জিনের বাদশা জাকির হোসেন পরি হাজির করে সেটি উদ্ধার করে দেয়ার কথা বলেন। এ সময় সে তার কাকীকে লিবার খারাপ হয়ে গেছে এবং সে বেশি দিন আর বাচবে না বলে জানালে বাড়ির সবাই ঘাবরে যান। এ সময় জিনের বাদশা জাকির হোসেন পরী হাজির করে তার কাছ থেকে চিকিৎসা নিলে তার কাকীর লিবার ভাল হয়ে যাবে বলেও জানান। এসব কথা শুনে প্রবসীর স্ত্রী মিসকাত জাহান উক্ত জিনের বাদশা জাকির হোসেনের উপর আস্থাভাজন হন।
আছিয়া খাতুন জানান, ঘটনার দিন রাতে সে তার বাবার ঘর থেকে খাবার খেয়ে এসে দাদী মরিয়ম বেগমের কাছে ও তার কাকী মিসকাত জাহান মিশু তার দুই শিশু কন্যা ইফাত জাহান (৯) ও নুর জাহান (৪) কে নিয়ে পাশের রুমে ঘুমান। এছাড়া অপর পাশের পৃথক দু’টি রুমে তার ফুফা শফিকুল আলম ও কাকা ভ্যান চালক ইউসুফ ঘুমান। মাঝ রাতে হঠাৎ করে তার রুমের মধ্যে জাকির হোসেন ও তার সহযোগী জুয়েল গিয়ে তাকে ডেকে তোলেন। এ সময় তারা আছিয়া খাতুনকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে তার কাকির রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে বলেন। এরপর তারা তার কাকীকে ডেকে তোলেন এবং তার সামনে থেকে পাশের রুমে নিয়ে যান। এ সময় সে বিভিন্ন সময় পাশের রুমের মধ্যে শব্দ শুনতে পেয়েছেন বলেও জানান। তাদের ভয়ে আছিয়া তার দুই চাচাতো বোনকে বুকের মধ্যে নিয়ে চুপ করে থাকেন। প্রায় আধা ঘন্টা পর জিনের বাদশা জাকির হোসেন তার সহযোগী জুয়েল ও কাকী শিশুকে নিয়ে তার কাছে এসে হাতে একটি কোরআন শরিফ দিয়ে কারও কাছে কোন কিছু না বলার জন্য শফত করান এবং তাদের কথা বলে দিলে তাকে জানে মেরে ফেলবে বলে বিভিন্ন রকম ভয়-ভীতি দেখান। এসময় সে তাদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিলে জাকির হোসেন ও তার সহযোগী জুয়েল ঘর থেকে চলে যান। পরে সে ও তার কাকী মিসকাত জাহান মিশু তার রুমে চুপ করে ঘুমিয়ে থাকেন। পরে রাত অনুমান ৪টার দিকে সে ফজরের নামজ পরতে ওঠেন। এ সময় আছিয়া তার রুমে গিয়ে বৃদ্ধা দাদী মরিয়ম বেগমকে দেখতে না পেয়ে তাকে খুজতে থাকেন। পরে তাকে ব্যালকুনীর মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন। এর পর সে পাশের ঘর থেকে তার বাবা কাপড় বিক্রেতা হারুন হাওলাদারকে ডেকে আনেন। সে এসে তার মা মরিয়ম বেগমকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। এ সময় তারা বাডির লোকজনকে ডেকে তোলেন। তারা আসার পর ঘর থেকে তার ফুফা শফিকুল আলম ও রুমে না পেয়ে অনেক খোজা-খুজির পর বাড়ির পিছনের পুকুর থেকে কাকা ইউসুফের লাশ উদ্ধার করে ঘরে নিয়ে আসেন।
এ বিষয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ শিশির কুমার পাল ও ওসি (তদন্ত) জাফর আহম্মেদ জানান, শনিবার সকালে খবর পেয়ে তারা তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং এ বিষয়টি তারা উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের অবহিত করেন। পরে তারা লাশের সুরাতহাল রিপোর্ট তৈরী করে ময়না তদন্তের জন্য বরিশাল শেবাচিম হাসপাতাল মর্গে পাঠান। এছাড়াও ঘটনার সাথে জড়িত থাকা প্রধান আসামী নলসিটি এলাকার জিনের বাদশা জাকির হোসেনকে তারা আটক করেন। পরে একই দিন রাত ১টার দিকে তারা র্যাব-৮ এর সহায়তায় জাকিরের সহযোগী জুয়েলকে আটক ও লুট করা মালামাল উদ্ধার করেন।
এ ব্যাপারে ওসি শিশির কুমার পাল জানান, শনিবার রাতে কুয়েত প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের ছোট ভাই ঢাকার গুলশান এন.আর.বি ব্যাংক কর্মকর্তা সুলতান মাহামুদ বাদী হয়ে এ ঘটনায় থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। থানার অফিসার ইচার্জ শিশির কুমার পাল নিজেই ওই মামলাটি তদন্ত করছেন বলেও তিনি জানান। এ ব্যাপারে মামলার বাদী এন.আর.বি ব্যাংক কর্মকর্তা সুলতান মাহামুদ বলেন, আসামী জাকির হোসেন ও তার সহযোগী জুয়েল আমার পরীবারের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে অর্থের লোভে তিন জনকে হত্যা করেছে। তিনি তাদের বিরুদ্ধে দুষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানান।
জিএমআর/এমআর