পর্যটকের উম্মাদনায় চর বিজয়ে পরিবেশ হুমকিতে

প্রথম পাতা » কুয়াকাটা » পর্যটকের উম্মাদনায় চর বিজয়ে পরিবেশ হুমকিতে
বুধবার ● ৪ ডিসেম্বর ২০১৯


পর্যটকের উম্মাদনায় চর বিজয়ে পরিবেশ হুমকিতে

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥

লাখ লাখ লাল কাঁকড়ার বিচরণের মনকাড়া দৃশ্য ও পাখিদের অভয়ারণ্যখ্যাত সদ্য জেগে ওঠা চন্দ্রাকৃতির চরবিজয়ে পর্যটকের বেপরোয়া বিচরণে মাত্র দুই বছরেই শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছে। কমে গেছে লাল কাকঁড়া অর্ধেকেরও বেশি। পাখিরাও স্বস্তিতে বিচরণ করতে পারছে না চরটিতে।
প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্রের পাশাপাশি পাখিদের অভয়ারণ্য রক্ষায় এচরটিতে পর্যটকের ভ্রমনে সরকারি কোন নির্দেশণা নেই। নেই কোন বিধি-নিষেধ। ফলে অঙ্কুরেই প্রকৃতির আরেক সৌন্দর্য চরবিজয়ের নৈসর্গিক দৃশ্য হারাতে বসেছে দখিনের মানুষ। পর্যটকরা চরটিতে গিয়ে সৃষ্টি করছে এক ধরনের উম্মাদনার। ধাওয়া করছে কাঁকড়া ধরার জন্য। ফলে কাঁকড়া মারা পড়ছে। আর পাখিরা নির্বিঘেœ বিচরণ কিংবা অবস্থান করতে না পারায় চর বিজয়ের অপুর্ব দৃশ্য হুমকির মুখে।
২০১৭ সালে থেকে জেগে ওঠা কুয়াকাটা থেকে ১৫কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ দিকে সাগর অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্ন এ চরটির আবিষ্কার করেন জেলেরা। তারা কেউ কেউ হাইরের চর বলে জানতেন। তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিজয়ের মাসে এ চরটিতে গিয়ে নামকরন করেন চর বিজয়। স্থানীয়দের দাবি এ নামকরন তারা করেছেন। এরপর থেকে চরটিতে কুয়াকাটার ট্যুরিজম ব্যবসায়ীরা পর্যটক দর্শনার্থীদের ভ্রমনে নিয়ে যেতে শুরু করেন। এ কারণে লাল কাকঁড়ায় পরিপূর্ণ চরটির কাকঁড়া এখন আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। মারা পড়ছে কিংবা পর্যটকের ধাওয়ায় হারিয়ে গেছে। পাখিরাও নিরাপদ মনে করছে না এখানে।
হাজার হাজার পাখি তাদের নিজের মতো করে চরটিতে বিচরণ করতো। দুর থেকে না দেখে কাছে গিয়ে দেখা, ছবি তোলার চেষ্টার কারণে বিরক্ত কিংবা ভয়ে পাখির বিচরণও কমে গেছে অর্ধেক। আর লাল কাঁকড়ার মিছিলও কমে গেছে। একটি নির্দিষ্ট দুরত্ব থেকে এসব জীব বৈচিত্র উপভোগ করার বিধি নিষেধ না থাকায় এমনটি হয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতামত পাখি কিংবা কাঁকড়া তাঁদের মতো স্বাধীনভাবে বিচরণ করবে। তাঁদের বিরক্ত করা ঠিক নয়। তাঁদের মতো করে থাকতে দিতে হবে। এছাড়া কিছু কিছু ট্যুরিস্ট নিয়ে স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ীরা ওই বিচ্ছিন্ন চরে রাত্রিযাপনে উৎসাহ যোগাচ্ছে। যেখানে যদি অনাকাঙ্খিত কোন ঘটনার শিকার হয় তার দায় সরকারকে নিতে হবে। ফ্রি-স্টাইলে পর্যটক-দর্শনার্থীকে নিয়ে রাখা খুবই বিপজ্জনক। সরকার পরিকল্পিতভাবে ট্যুরিস্ট ভ্রমনের উপযোগী হিসেবে ঘোষণার আগেই বেসরকারি ব্যক্তি উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা পর্যটককে সেখানে নিয়ে বিপদের সম্মুখীন করলে এর দায় কে নেবে; এটি এখন শঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চারদিকে যতদুর চোখ যায় শুধু সাগরের অথৈ জলরাশি। তারই মাঝখানে নয়ন ভোলানো এই বিশাল চর। চারদিকেই সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে অনবরত। চরটি চন্দ্রাকৃতির। পশ্চিম দিকটায় হাজারো পাখির কলতানে মুখরিত থাকত। আর গোটা চরটিতে ছিল লাল কাঁকড়ার দৌড়াদৌড়ির এক স্মৃতিময় মনকাড়া সুন্দরের দৃশ্য। আবার মানুষের পদচারনায় মুহুর্তেই কাঁকড়াদের গর্তে লুকানো। যেন না দেখলে বোঝানো যায় না। আনুমানিক দেড় কিলোমিটার প্রস্থ এবং তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এ চরটি। প্রায় ছয় বর্গকিলোমিটার আয়তন। রয়েছে সংযুক্ত ডুবোচর। পর্যটকের পদচারনা রয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এ দৃশ্য দেখা গেছে। এখন আর নেই ওই মনোলোভা দৃশ্য।
তখনকার জেলা প্রশাসক জানান, প্রকৃতির দান এ চরটিতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পর্যটনসহ বনায়ন করার জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া হবে। তাৎক্ষণিক কোন কিছু করা সমীচীন মনে হচ্ছে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পরিবেশ প্রতিবেশসহ সকল বৈচিত্র অক্ষুণœ রেখে চরটির উন্নয়ন সাধিত হবে। পাখির অভয়ারণ্য রক্ষায় সচেষ্ট থাকতে হবে। তবে সবার আগে বনায়নের কাজ করার কথা জানালেন তিনি। ইতোমধ্যে চরটিতে কুয়াকাটা থেকে পর্যটকরা যাচ্ছেন। দেখছেন সাগরের মাঝখানে জেগে ওঠা এই চরটির সৌন্দর্য। কয়েকজন জেলে ওখানে মাছ ধরতে গিয়ে শুকনো মৌসুমে অবস্থান করছেন।
জেলেদের কাছ থেকে জানা গেছে, মূলত এটি সাগরের পানি প্রবাহের প্রবল ¯্রােতধারার কাছে অবস্থিত। এ ¯্রােতধারার মুখেই জেলেরা ইলিশ ধরার জন্য জাল পেতে থাকেন। স্থানীয় জেলেরা পানির প্রবল এ ¯্রােতধারার কারণে এটাকে ‘হাইরের চর’ বলে থাকেন। হাইর হলো জেলেদের মাছ ধরার জন্য নির্ধারিত সীমানা। প্রকৃতিপ্রেমিক ও ভ্রমণপিয়াসী আরিফুর রহমানসহ ওইসময় একদল পর্যটক বিজয়ের ওই মাসে চরটি দর্শনে গিয়ে ‘চর-বিজয়’ নামকরন করেন। পরিবেশবাদীদের অভিমত, এ চরে নানান ধরণের পাখি, লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ রয়েছে। এসব যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রণিবিজ্ঞান বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মনির জানান, এচরটিতে পাখি, লাল কাঁকড়াসহ পরিবেশ প্রতিবেশ রক্ষায় পরিবেশবাদীদের পরামর্শ নিয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। ইকোট্যুরিজম এর আওতায় এটির সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
কলাপাড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মুনিবুর রহমান জানান, এচরটিতে পর্যটকদের অতি সাবধানে বিচরন করতে হবে। কারণ পরিবেশ-প্রতিবেশ অতিথি পাখি, লাল কাঁকড়ার বিচরণ কোন কিছুর ক্ষতি করা যাবে না। রাতে কেউ যাতে ওখানে অবস্থান করতে না পারে এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে জেলেদের শঙ্কা ওই চরটি দিনের বেলা ছাড়া ভ্রমন করা ঠিক না। কারন নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে। চরটির আশপাশে জলদস্যুরা রাতে কিংবা যে কোন সময় বহুবার জেলে ট্রলারে হামলা লুটপাট চালিয়েছে। একারণে নিরাপত্তার বিষয়টি আগে নিশ্চিত করে পর্যটকের বিচরণ করার অনুমতি দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এচরটি ঘিরে কুয়াকাটা-গঙ্গামতির মতো সম্ভাবনা গড়ে উঠছে। আর বেড়েছে সমুদ্রের মধ্যে বাংলাদেশের চর এলাকা।

এমইউএম/এমআর

বাংলাদেশ সময়: ২১:৪৩:৪৫ ● ৯০৩ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ