ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
জিয়া এতিমখানা দুর্নীতির মামলায় অন্য আসামিদের ১০ বছর কারাদণ্ড দিলেও বয়স, রাজনৈতিক অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনায় খালেদা জিয়াকে শাস্তি পাঁচ বছর কম দিয়েছিল জজ আদালত। আপিলের রায়ে হাইকোর্ট খালেদার শাস্তিও বাড়িয়ে অন্য আসামিদের মতো ১০ বছর কারাদণ্ড করেছে। তার ব্যাখ্যায় উচ্চ আদালত বলেছে, প্রধান আসামির শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদার সাজা বাড়িয়ে দেওয়া হাই কোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সোমবার প্রকাশের পর উচ্চ আদালতের এই ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বিদেশ থেকে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের নামে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর এবং তারেক রহমানসহ অন্য পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ডের রায় বিগত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দিয়েছিলেন ঢাকার বিশেষ জজ আখতারুজ্জামান। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় দোষি সাব্যস্ত করে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়।
এই ধারায় বলা আছে, কেউ কোনো সম্পত্তি বা কোনো সম্পত্তির উপর আধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হয়ে সম্পত্তি সম্পর্কে অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করলে যাবজ্জীবন কারাদ- বা ১০ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দ-িত হবে। এই রায়ের পর থেকে কারাবন্দি খালেদাসহ তিন আসামির আপিল এবং দুদকের একটি রিভিশন আবেদনের উপর শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ ৩০ অক্টোবর রায় দেয়। তাতে খালেদার সাজাও এই ধারায় সর্বোচ্চ ১০ বছর করা হয়। তার প্রায় তিন মাস পর ১৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হল। মামলাটিতে খালেদা জিয়াকে মূল অপরাধী অ্যাখ্যা দিয়ে উচ্চ আদালত রায়ে বলেছে, আমাদের বিবেচনায় মূল আসামি হিসেবে বেগম খালেদা জিয়াকে দ-বিধির ৪০৯/১০৯ ধারায় এ দ-াদেশ (বিচারিক আদালতের দেওয়া পাঁচ বছরের সাজা) যথাযথ হয়নি। বরং প্রধান আসামি হিসেবে খালেদা জিয়া দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারার পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা অনুযায়ীও দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাকে (খালেদা জিয়াকে) সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। কারণ সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্রে যাতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়। বিচারিক আদালতের দণ্ডের প্রসঙ্গে ধরে হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, নিম্ন আদালত খালেদা জিয়াকে সাজা কম দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স, অসুস্থতা ও তার রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করার যুক্তি দেখিয়েছে। মূল আসামিকে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। রায়ে হাই কোর্ট বলেছে, দুর্নীতি বা অর্থনৈতিক অপরাধ কেবল একটি দেশের সুশাসনের কবরই রচনা করে না, এটি গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও হুমকি সৃষ্টি করে। এটা তর্কাতীত বিষয় যে, দুর্নীতি সব অধিকার কেড়ে নেয়। দুর্নীতি মানবাধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, উন্নয়নকে গিলে খায়, ন্যায়বিচার, সাম্য-স্বাধীনতা-সহমর্মিতাকে তাচ্ছিল্য করে, যা আমাদের সংবিধানে সবার উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে।
রায়ে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার এতিমের কল্যাণে কাজ করার দায়িত্ব ছিল। সেখানে ভুয়া ট্রাস্ট খুলে আত্মীয়স্বজন ও দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে এতিমের তহবিল পরিচালনা করা হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে শক্তিশালী করাকে আদালতের কর্তব্য উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে, তাই যেখানে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, সেখানে অপরাধীদের সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে নমনীয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা মনে করেছি, খালেদা জিয়াকে দ-বিধির ৪০৯ ধারায় সর্বোচ্চ শস্তি দেওয়াই হবে যথাযথ বিচার। এ মামলায় দ-িত অন্য আসামিরা হলেন মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ।
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এই মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ৫ অগাস্ট অভিযোগপত্র দেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ। অভিযোগে বলা হয়, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এ মামলার আসামিরা। মামলা হওয়ার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠন হয় খালেদা জিয়াসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে; তারও চার বছর পর শেষ হয় বিচার।
এফএন/এমআর