কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সাগরকন্যা অফিস॥
তুই হান্ডি-পাতিল ঘষবি। চুলার কাজ করবি। থাকবি আমার পায়ের নিচে। স্বামী ইমরান হোসাইনের এমন কঠোর নিষেধ উপেক্ষা করে অনার্স পর্যন্ত লেখাপড়া করায় তিন দিন আটকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। কিল-ঘুষি, লাথিসহ লাঠিপেটায় অচেতন হয়ে পড়ে। তারপরও ঘরের দোতলায় নিয়ে আটকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তলপেটের লাথিতে অচেতন হয়ে পড়ে।
সোমবার সকাল ১০টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত আটকে রেখে কিছুই খেতে দেয়া হয়নি। বারন তো দূরের কথা ; শ^শুর-শাশুড়ি, চাচা শশুর পর্যন্ত উস্কে দিয়েছে। এমন নির্যাতনের শরীর নিয়ে এখন অসহ্য যন্ত্রনায় কলাপাড়া হাসপাতালের ১১ নম্বর বেডে কাতরাচ্ছে নিঃসন্তান তরুণী গৃহবধূ লাবনী আক্তার। শনিবার (১৬ নবেম্বর ) দুপুরেও অঝোর ধারায় কান্না জুড়ে দিয়ে নির্যাতনের ভয়াবহতা বলছেন আর বিচার চেয়ে আহাজারি করছেন এ গৃহবধূ। মেয়ের কান্নায় অসহায় বাবা আবুল কাশেমও কান্না জুড়ে দেন। অনার্সে (সমাজবিজ্ঞান) প্রথম শ্রেণিতে উর্ত্তীর্ণ মেধাবী লাবনীর স্বপ্ন ছিল কলেজের শিক্ষকতা করার। সেই স্বপ্নের দৌড়ে যখন অদম্য স্পৃহা আর ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে এগুচ্ছিল। প্রথম বর্ষে পড়ছিল, তখনই বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পরই লেখপড়ায় জগদ্দল পাথরের মতো বাধা হয়ে দাড়ায় চাকরিজীবী আনসার সদস্য ইমরান। প্রথমদফায় বই ছিড়ে ফেলে। তারপরও বাবার বাড়ি কলাপাড়ার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের আরামগঞ্জ গ্রামে থেকে বাবার খরচে লেখাপড়া চালিয়ে আসছিল।
২০১৬ সালের ২০ মে রাঙ্গাবালীর বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের ছাতিয়ানপাড়া গ্রামের চাকরিজীবী জাকির হোসেনের ছেলে ইমরানের সঙ্গে বিয়ে হয় লাবনীর। বিয়ের আট মাস পরে তুলে নেয় তাকে। এরপরই আসল চেহারা ধরা পড়ে লাবনীর কাছে। স্বামীর সংসারের সবাই জোট বেধে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালায় এ তরুণী গৃহবধূর ওপর। নেমে আসে স্বামীর আদর-ভালবাসার বদলে উম্মত্ত আচরণ। লাবনীর দাবি তিন বছরে কমপক্ষে তিন শ’ বার তাকে মারধর করা হয়েছে। মাইক্রো কিনে ব্যবসা করবে এজন্য বাবার বাড়ি থেকে টাকা নেয়ার জন্য পর্যন্ত চাপ দিয়েছে। তারপরও এত শ^াপদ শঙ্কুল পরিবেশে লুকিয়ে লুকিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যায় লাবনী।
সবশেষ সোমবার দুপুর থেকে নানা ছলছুতো সৃষ্টি করে বেধড়ক মারধর শুরু হয়। বিকেল সাড়ে চারটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত মারধর করা হয় বলে লাবনীর অভিযোগ। এক পর্যায় দোতলায় তুলে নিয়ে আটকে রাখা হয়। পাষন্ড স্বামী ইমরান ছুটিতে আগেই বাড়িতে ছিল। কাউকে খবর দেয়ার জন্য ব্যবহৃত মোবাইল সেটটি আগেই ভেঙ্গে ফেলে। কোন কিছু খেতে না দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। লাবনীর বাবাসহ স্বজনেরা কলাপাড়া বন্দর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দিদার উদ্দিন আহম্মেদ মাসুম বেপারীর সহায়তায় বৃহস্পতিবার কলাপাড়ায় নিয়ে আসেন। শুক্রবার কলাপাড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
লাবনী জানায় তার পিঠে মেরুদন্ডে এবং তলপেটে লাথির আঘাতে এখন সোজা হয়ে বসতে পারে না। চিকিৎসক জেএইচ খান লেলিন জানান, লাবনী শারীরিক আঘাতের পাশাপাশি সবেচেয়ে বেশি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অভিযুক্ত ইমরান হোসাইন জানান, মারধরের কোন ঘটনা ঘটেনি। যেটুকু সমস্যা হয়েছে তা সমাধানের জন্য আমরা স্ব-পরিবারে বৃহস্পতিবার কলাপাড়ায় যাই। সেখানে গিয়ে সমাধানের জন্য বসা হয়েছে। লাবনির পরিবার কয়েকদিন সময় চেয়েছেন। আমার ছুটি শেষ তাই কর্মস্থলে চলে যাচ্ছি। কলাপাড়ার মাসুম আঙ্কেল সব জানেন। তার সঙ্গে কথা বলেন। লাবনীর শ^শুর জাকির হোসেন জানান, তাঁরা মারধর করেননি। সম্পুর্ণ মিথ্যা কথা। লাবনীর চালচলনে তাঁরা গোটা পরিবার উল্টো তটস্থ থাকেন। আচরন বেপরোয়া। তারপরও নিজেদের টাকা-পয়সা খরচ করে লেখাপড়া করিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পরিবারের সবাই লাবনীর জ¦ালায় অসহনীয় পর্যায়ে পৌছেছি। সে তার ইচ্ছামতো চলাফেরা করে। এসব নিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে রাগের বশে একটি থাপ্পড় দেয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি। এসব নিয়ে ওই পরিবারের সঙ্গে চার দফা সালিশ বৈঠক হয়েছে বলেও জাকির হোসেন জানালেন।
এমইউএম/এমআর