ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
দেশের নদীবন্দরগুলো পুরনো, জীর্ণ ও অপ্রতুল অবকাঠামো দিয়ে চলছে। ফলে মাশুল দিয়েও বন্দর ব্যবহারকারীরা কাঙ্খিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে গেজেটভুক্ত নদীবন্দর আছে ৩২টি। তার মধ্যে বেশকিছু এখনো চালু হয়নি। আর যেগুলো চালু আছে সেগুলোও পুরনো, জীর্ণ ও অপ্রতুল অবকাঠামো দিয়ে চলছে। কোনো কোনো নৌবন্দরে সেবার ন্যূনতম ব্যবস্থাও নেই। অনেক বন্দরের পুরনো জেটি সংস্কারের উদ্যোগ নেই। ফলে ওসব বন্দরে পণ্য খালাসে নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নৌবন্দর ইজারার শর্তানুযায়ী লাইসেন্সগ্রহীতা নিজ খরচে বন্দরে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করবেন। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা, সৌন্দর্যবর্ধন ও বৃক্ষরোপণ করবেন। কিন্তু অধিকাংশ নৌবন্দরেই বিশুদ্ধ পানির কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আলো থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। আর বৃক্ষরোপণেরও উদ্যোগ নেননি কোনো ইজারাদার। বরং ইজারাদারদের বিরুদ্ধে পণ্যবাহী কার্গো থেকে অতিরিক্ত শুল্ক আদায়, হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ইজারার শর্ত অনুযায়ী প্রতি ঘনফুট পণ্য থেকে ২৫ পয়সা করে শুল্ক আদায় করার কথা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ইজারাদাররা এর চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করে।
সূত্র জানায়, ছাতক নদীবন্দরে ছোট্ট একটি যাত্রী ছাউনি থাকলেও সুনামগঞ্জের টাকেরঘাটে তা-ও নেই। সেখানে ইজারাদারদের টং দোকানের মতো একটি স্থাপনা আছে মাত্র। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী নদীবন্দরে চার দশক আগে তিনটি জেটি নির্মাণ করা হয়। এরপর জেটির সংখ্যা আর বাড়েনি। পুরনোগুলোও সংস্কার হয়নি। যদিও এ বন্দর ব্যবহার করেই ইরি-বোরো মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার ২৬টি বাফার গুদামে পণ্য পাঠানো হয়। তাছাড়া উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার জ্বালানি তেল, কয়লা, গমসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহেরও প্রধান মাধ্যম এই নদীবন্দর। অথচ প্রতি বছরই নাব্য সংকটে জাহাজ চলাচল বিঘিœত হয়। তাছাড়া বন্দরের জেটি পুরনো হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের ঝুঁকি নিয়ে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ করতে হয়। পুরনো জরাজীর্ণ ঘাট ব্যবস্থায় চলছে নদীবন্দরটি। আর এক সময়ের প্রসিদ্ধ চিলমারী নদীবন্দরে কেবল সাইনবোর্ডই আছে। সেখানে পণ্য নিয়ে জাহাজ ভেড়ে না। নারায়ণগঞ্জের বরফকল এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে গড়ে ওঠা নদীবন্দরটি একটিমাত্র জেটিতে চলছে। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে নির্মিত এ জেটি দিয়ে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মালামাল লোড-আনলোড হচ্ছে। তবে বন্দর ব্যবহারকারীদের জন্য রাখা হয়নি বসার জায়গা। নেই অফিস বা শেডও।
সূত্র আরো জানায়, যশোরের নওয়াপাড়া নদীবন্দরে ৮টি জেটি আছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ওসব জেটি ব্যবহার করছে না। মূলত নদীর তীর থেকে জেটি ও পন্টুন অনেক দূরে হওয়ার কারণে সময় ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় সেগুলো তারা ব্যবহার করছেন না। তাছাড়া ওয়্যারহাউজের সুবিধা বৃদ্ধি, নদীভাঙন রোধে কি-ওয়াল, পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য আরসিসি সিঁড়ি ও মালবাহী ট্রাকের জন্য পার্কিং ইয়ার্ডও নির্মাণ করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। ফলে রাজস্ব দিয়েও কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা। অথচ প্রতি বছর বন্দরটি দিয়ে পণ্য আমদানি বাড়ছে। আমদানি করা সার ও খাদ্যশস্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে বড় জাহাজ থেকে খালাসের পর ছোট বার্জ ও কার্গোতে করে নদীপথে তা নওয়াপাড়া নদীবন্দরে আনা হয়। ভারত থেকে স্থলপথে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তারও বেশির ভাগ রেলের ওয়াগনে করে দর্শনা স্থলবন্দর হয়ে নওয়াপাড়ায় আনা হয়। ওসব পণ্য পরে সড়ক ও নদীপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। কিন্তু সে অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে না। অথচ আধুনিকায়নের মাধ্যমে বন্দরের সেবার মান বাড়ালে ব্যবসায়ীরা এটি ব্যবহারে আরো বেশি আগ্রহী হবে। তাছাড়া একসময় দেশের ঐতিহ্যবাহী নৌবন্দর ছিল কুড়িগ্রামের চিলমারী নৌবন্দর। চিলমারীর এ নদীবন্দরকে ঘিরেই উত্তরাঞ্চলের বাণিজ্য পরিচালিত হতো। মহাজনরা এ চিলমারী বন্দর থেকেই পণ্য নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এ বন্দর দিয়েই এ অঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য পাঠানো হতো দেশের বিভিন্ন স্থানে। বড় বড় জাহাজ ভিড়ত। কর্মসংস্থান ছিল অনেক মানুষের। বর্তমানে সেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষের এক কক্ষবিশিষ্ট একটি ঘর। আর আছে একটি সাইন বোর্ড। ঘর থাকলেও বন্দর কর্তৃপক্ষের কেউ সেখানে থাকেন না। ঘরটি এখন নৌকা ঘাটের লোকজন ব্যবহার করছে। ১৫ বছর আগেও এই নৌবন্দরে বড় বড় জাহাজ ভিড়ত। কিন্তু নাব্য সংকটে আর কোনো জাহাজ ভিড়তে পারছে না।
এদিকে বিভিন্ন নদীবন্দর সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, দেশের নৌবন্দরগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে সব বন্দরে অবকাঠামো নির্মিত হবে। আর অবকাঠামো নির্মিত হলে তাতে সব সেবার ব্যবস্থা থাকবে।
অন্যদিকে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, দেশের নদীবন্দরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ চলছে। দেশে যে বন্দরগুলো রয়েছে, তার প্রতিটাকে আরো আধুনিকায়নের জন্য প্রকল্প নেয়া হচ্ছে এবং প্রকল্প নেয়া আছে। নদীপথ বৃদ্ধি করতে হলে এ নদীবন্দরগুলোকেও উন্নত করতে হবে। সরকার তা করবে।
এফএন/এমআর