ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
দেশের বাইরে ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাংলাদেশে তৈরি আসবাবপত্র বা ফার্নিচার। বিগত এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে এর রফতানি আয়। ফলে বিশ্ববাজারে ইতোমধ্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশের আসবাবপত্র। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ কোটি ৪৮ লাখ মার্কিন ডলারের আসবাব রফতানি করে বাংলাদেশ। এ অঙ্ক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৭ শতাংশ বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় বিগত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বাড়ে ১৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে আসবাবপত্র রফতানি হয়েছিল ৬ কোটি ৩১ লাখ ডলারের। এর আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ আসবাব রফতানি করে এক কোটি ৯২ লাখ ডলার আয় করেছিল। সে হিসেবে ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৮-১৯ পর্যন্ত দশটি অর্থবছরে আসবাব রফতানি আয় বেড়েছে ৫ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।
এদিকে, কয়েক বছর আগেও বিদেশি আসবাবপত্রের চাহিদা ছিল বেশী। কিন্তু এখন আর তা নেই। বাংলাদেশি আসবাবপত্র দেশের বাজারে ক্রমেই শক্তিশালী অবস্থান করে নিচ্ছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের বাজারেও বাংলাদেশের তৈরি আসবাব পাওয়া যাচ্ছে। চাহিদা থাকায় প্রতিবছর এ খাত থেকে রফতানি বাড়ছে। দেশের স্বনামধন্য আসবাব নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোই মূলত রফতানিবাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে দেশের বাজারে চাহিদা মেটাতে গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার ছোট ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দেড় যুগ আগেও আসবাব তৈরির সঙ্গে মূলত ক্ষুদ্র ও কিছু মাঝারি মানের কারখানাই যুক্ত ছিল। তখন নির্মিত আসবাবের মূল চাহিদা ছিল ঘরবাড়িতে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবাবের চাহিদা বাড়তে থাকে। ফলে বড় কিছু উদ্যোক্তা দেশের বাইরে আসবাব রফতানিতে এগিয়ে আসেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৯৭ সাল থেকে আসবাবপত্র বিদেশে রফতানি শুরু হয়। বর্তমানে ভারত, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, জার্মানিসহ বিশ্বের ১৫টি দেশে রফতানি করা হয়। কাঠের তৈরি গৃহেও জাহাজে ব্যবহার্য আসবাবই বর্তমানে বেশি রফতানি হচ্ছে। তবে ভারতে অফিস ফার্নিচার ও জাপানে কাঠের তৈরি টাইলস রফতানি হয়। অটবি, নাভানা, আক্তার, হাতিল, ব্রাদার্স, পারটেক্স ও ফার্নিটেকের মতো প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানের আসবাব তৈরি করছে। এরাই বাংলাদেশের আসবাবশিল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি করছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় সব মিলিয়ে দেশে ৪০ হাজারের বেশি কারখানা রয়েছে। বর্তমানে আসবাবশিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১৬ থেকে ১৮ লাখ মানুষ জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। একাধিক সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে যে, আসবাবের বার্ষিক বাজার ১০ থেকে ১১ হাজার কোটি টাকার। গড়ে প্রতিবছর ১৫ শতাংশ হারে এই খাতের বিকাশ ঘটছে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এই খাতের অবদান প্রায় দশমিক ৩০ শতাংশ।
দীর্ঘস্থায়িত্ব বিবেচনায় অবশ্য দেশিয় ভোক্তাদের পছন্দের তালিকায় এখনো কাঠের তৈরি আসবাব শীর্ষে। বর্তমানে সেগুন, টিকমেহগনি, ওক, চেরি প্রভৃতি কাঠ মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা হয়। আর কারুকাজময় কাঠের তৈরি আসবাবই মূলত বিদেশে রফতানি হচ্ছে। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, উন্নত দেশে এখন পুরোপুরি কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে আসবাব তৈরি হয়, কিন্তু আমাদের দেশে পুরোটাই হাতে তৈরি। গুটিকয়েক বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউই স্বয়ংক্রিয় নির্মাণপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে না। তাই মান ও নকশার দিক থেকে উন্নত দেশের চেয়ে এখনো বাংলাদেশে এই খাত পিছিয়ে আছে। সে কারণেই এখনো প্রতিবছর দেশে বিপুল পরিমাণ আসবাব আমদানি করা হয়। অফিস, হোটেল, হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য এখনো অনেকেই বিদেশী আসবাবের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন।
কাঠের তৈরি আসবাবের চাহিদা থাকার পরও নির্মাণের খরচ ও দাম বেড়ে যাওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিকল্প উপাদান (বিভিন্ন ধরনের বোর্ড) দিয়ে আসবাব তৈরি করছেন নির্মাতারা। সেগুন বা মেহগনি কাঠের চেয়ে এসব বিকল্প উপাদান দিয়ে তৈরি আসবাব সাশ্রয়ী হওয়ায় ভোক্তাদের কাছে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো পারটেক্স, এমডি, লেমিনেটেড, পলিসহ বিভিন্ন ধরনের বোর্ড দিয়ে আসবাব তৈরি করছে। বর্তমানে অফিস, ঘরবাড়ি কিংবা হাসপাতালে এসব বোর্ডের আসবাব ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এসব বোর্ড বাংলাদেশে তৈরি হয় না। সাধারণত মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও চীন থেকে আমদানি করতে হয়। তাই দাম বেড়ে যায়।
আসবাবপত্র শিল্পকে আরো এগিয়ে নিতে কিছু প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কহার কমানোর দাবি ব্যবসায়ীদের। দেশের আসবাবপত্র শিল্পকে স্থায়ী রফতানি পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। আসবাবপত্র রফতানিতে দেওয়া হচ্ছে ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা। নতুন বাজার সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য তৈরিতে সরকার ব্যবসায়ীদের সহায়তা করছে।
এদিকে, আসবাব রফতানি বাড়াতে বন্ড-সুবিধা চান উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, আসবাব রফতানিতে সরকার ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কারণ, আসবাবের সরঞ্জাম আমদানিতে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। তাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করা যায় না।
এফএন/এমআর