ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
বাংলাদেশ রেলওয়ের বিপুলসংখ্যক প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলছে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের ব্যয় ১০ গুণেরও বেশি বেড়েছে। ৩৮টি প্রকল্পের মধ্যে মেগা ১২ প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২১ শতাংশ। বাকি প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ২৩ শতাংশেরও কম। ওসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৬৭ কোটি ৮১ লাখ ৫২ হাজার টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পের ব্যয় ২৩ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা বেড়েছে। ওসব প্রকল্পের কোনোটি প্রায় ১০ বছর ধরে চলছে। অন্যগুলোও কচ্ছপ গতিতে চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের এমন দুরবস্থায় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পোয়াবারো। বছরের পর বছর শুধু প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে অনেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ফাউ হিসেবে পাচ্ছে একাধিক দেশ ভ্রমণের সুযোগ। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ১২টি মেগা প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের আগস্ট পর্যন্ত (দুই মাসে) এডিপি বরাদ্দের মাত্র ১ দশমিক ১৭ শতাংশ অর্থ খরচ হয়েছে। আগামী ১০ মাসের মধ্যে ৯২ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থ খরচ করতে হবে। দীর্ঘ ৯ বছরে দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম ডাবল-ব্রড গেজ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি মাত্র ২৯ শতাংশ। ব্যয় বৃদ্ধির পর ওই প্রকল্পের আকার দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। ২০১০ সালে প্রকল্পটি পাস হওয়ার সময় ব্যয় মাত্র ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। আর ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। ২০১৬ সালে প্রকল্পের সংশোধনী এনে ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে সিঙ্গেল গেজের পরিবর্তে এখন ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। বেশ কিছু স্থানে বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা এবং মামলার কারণে প্রকল্পটি বাধার মুখে পড়েছে। ওসব বাধা দ্রুত দূর করতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। এর মেয়াদ ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ উন্নয়ন প্রকল্পের অবস্থাও খুব নাজুক। ৮ বছরে ওই প্রকল্পের মূল কাজের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। প্রকল্পটি ২০১২ সালের ১ জুলাই শুরু হয়। ২০১৫ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ৮৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় ১ হাজার ১০৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অর্থাৎ ১৯৮ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পদ্মা সেতু রেললিংক লাইন প্রকল্পের অগ্রগতিও বেশ পিছিয়ে রয়েছে। সাড়ে ৪ বছরে প্রকল্পের মাত্র ১৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হলেও তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
খুলনা থেকে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত প্রকল্প। প্রায় ১০ বছরে ওই প্রকল্পের কাজ ৫৮ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়েছে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা ধরা হয়। বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ৮১ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। আর ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ওই প্রকল্পের কাজ ১০ বছরে ৫৮ শতাংশ হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু উন্নয়ন প্রকল্পের ৪ বছরেও কোনো অগ্রগতি নেই। এটি ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু এর দৃশ্যমান অগ্রগতিই নেই। কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠপর্যায়ে অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ। প্রকল্পটি চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হওয়ার কথা। আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েল গেজ রেল সংযোগ নির্মাণ প্রকল্প ৪ বছর ধরে চলছে। কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩২ শতাংশ। মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা শহর পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে প্রায় দেড় বছরে মাত্র শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ কাজ হয়েছে। জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পটির ৯ মাসেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। মেগা প্রকল্পের ২০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ ও ১৫০টি কোচ কেনার অগ্রগতি মাত্র ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ। তাছাড়া ২০১৭ সালের ৩ হাজার ৬০২ কোটি আট লাখ টাকায় শুরু হওয়া রোলিং স্টক সংগ্রহ প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০০৭ সালে শুরু হওয়া পাহাড়তলী ওয়ার্কশপ উন্নয়ন প্রকল্পটির কাজ শুরুই হয়নি। প্রায় দুই বছর আগে পার্বতীপুর-কাউনিয়া পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রূপান্তর প্রকল্পটির অগ্রগতি শূন্যের কোঠায়। ২০১৬ সালের ২০০ মিটারগেজ ক্যারেজ সংগ্রহ প্রকল্পটির অগ্রগতি শূন্য দশমিক শূন্য তিন শতাংশ।
এদিকে রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি প্রসঙ্গে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলছেন, এক ব্যক্তি একাধিক প্রকল্পের পরিচালক হওয়া, সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা না থাকা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় পুরো রেলেই গতি আসছে না। লোকসানও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এছাড়া প্রকল্প কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাবও রয়েছে। বিদেশি লোকবল দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। চরম দুর্নীতি করা হচ্ছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, রেলে একটার পর একটা প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। কিন্তু যাত্রীসেবা যেমন বাড়েনি, আবার লোকসানও কমেনি। প্রকল্প ঘিরে চলছে লুটপাট। প্রকল্পের শুরুতে যেমন অবাস্তব ব্যয় ধরা হচ্ছে, পাশাপাশি বিলম্বে বাস্তবায়ন করে ব্যয় বহুগুণ বাড়ানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে বারবার বৈঠক করা হয়েছে। সর্বশেষ ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকেও প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের যথাসময়ে প্রকল্প শেষ করতে কঠোরভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
একই প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন জানান, প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করতে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। প্রকল্পের ধীরগতির কারণ এবং সংশ্লিষ্টদের কর্মকা- কঠোরভাবে দেখা হচ্ছে। কিছু প্রকল্পের চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হতেই ২ থেকে ৩ বছর লেগে যায়। মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হতেও দেরি হয়। আমরা চাই, প্রকল্পগুলোর সময় যেন আর বৃদ্ধি না করা হয়। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে কঠোর নির্দেশ দেয়া রয়েছে। প্রকল্পে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা বিশেষভাবে দেখা হচ্ছে। কারও গাফিলতি সহ্য করা হবে না।
এফএন/এমআর