ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
দেশে মাছের মোট উৎপাদন প্রায় ৪৩ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। এদিকে মাছ উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় কয়েক বছর আগেও আমদানিকৃত মাছের চাহিদা ছিল। তবে এখন উৎপাদন বাড়ায় বাংলাদেশে মাছ আমদানির পরিমাণও কমেছে। জানা গেছে, দেশে প্রতিবছর ৯ শতাংশ হারে মাছের উৎপাদন বাড়ছে। ১৯৮৪ সালে যেখানে ১ লাখ ২০ হাজার টন মাছ উৎপাদন হতো ২০১৪ সালে তা দাঁড়ায় ২০ লাখ টনে। আর গতবছর ৪২.৭৭ টন মাছ উৎপাদন হয়েছে।
বিশ^ব্যাংকের ‘হারভেস্টিং প্রসপারিটি: টেকনোলজি অ্যান্ড প্রোডাক্টিভিটি ইন এগ্রিকালচার’ শীর্ষক সর্বশেষ এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০১ সালে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৮৯৬ হেক্টর জমিতে মাছ চাষ হতো, ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৪৯৩ হেক্টরে। প্রতি হেক্টরে মাছের উৎপাদন ১ টন থেকে বেড়ে ২ দশমিক ২ টন হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বলা হয়েছে, বিশ্বের সাতটি দেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অর্ধেকেরও বেশি আসে মাছ থেকে। প্রাণিজ আমিষের ৫৮ শতাংশ মাছ দিয়ে মিটিয়ে শীর্ষস্থানীয় দেশের কাতারে এখন বাংলাদেশ। যেখানে বিশ্বে গড়ে প্রাণিজ আমিষের ২০ শতাংশ আসে মাছ থেকে।
এদিকে, অতিসম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু বলেছেন, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের অধিক মানুষ মৎস্য খাতের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় দেশের জিডিপির ৩.৫৭ শতাংশ অর্জিত হয় মৎস্যখাত থেকে। আশির দশকে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৮ লাখ মেট্রিক টন এবং এর প্রায় ৮০ শতাংশ ছিল নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় ও বিলের মাছ। আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টায় এখন মাছের মোট উৎপাদন ৪২.৭৭ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশ আসে চাষাবাদ থেকে, ২৮ শতাংশ নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়সহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় থেকে এবং ১৬ শতাংশ আসে সমুদ্র থেকে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা করে বিলুপ্তপ্রায় ৬৪টি মাছের মধ্যে ইতোমধ্যে ২১টি মাছের জিনপুল সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।
বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, এক দশক আগে অর্থাৎ ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন ছিল মাত্র ২৫ লাখ ৬৩ হাজার টন। পরের অর্থবছরগুলোয় মাছ উৎপাদন ক্রমেই বাড়েতে থাকে। ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত সাত অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎসে মাছ উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ২৭ লাখ, ২৯ লাখ, ৩০ লাখ ৬১ হাজার, ৩২ লাখ ৬২ হাজার, ৩৪ লাখ ১০ হাজার, ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ও ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার টন।
এদিকে, উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছ আমদানির পরিমাণও কমে গেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে মাছ আমদানি হয়েছে ৪৫ হাজার ৮৬০ টন। আগের অর্থবছরে (২০১৬-১৭) এর পরিমাণ ছিল ৭৮ হাজার টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মাছ আমদানির পরিমাণ কমে ৩২ হাজার ১৪০ টন। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মাছ আমদানি হয় প্রায় ৮৮ হাজার টন। এ হিসাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি কমেছিল ১০ হাজার টন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মাছ উৎপাদন বাড়ার কারণে আমদানির পরিমাণ কমছে। এ ছাড়া আগে চট্টগ্রামেই আমদানিকৃত মাছ পরীক্ষার পর তা বাজারজাতের সুযোগ থাকলেও এখন ঢাকায় পরীক্ষার পর বাজারজাত করতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় আমদানিকৃত মাছ বাজারজাতে সময় বেশি লেগে যায়। ফলে আমদানিকারকরা মাছ আমদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
জানা গেছে, গত অর্থবছরে দেশে ২ কোটি ৭৬ লাখ ১০ হাজার ডলারের মাছ আমদানি করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মিঠা পানির ও সামুদ্রিক মাছ আমদানি হয়। এসব দেশের মধ্যে ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, ইয়েমেন ও উরুগুয়ে উল্লেখযোগ্য। আমদানিকৃত স্বাদু পানির মাছের মধ্যে কার্পজাতীয় রুই ও কাতল রয়েছে। ক্যাটফিশজাতীয় মাছের মধ্যে রয়েছে মাগুর, শিং, বোয়াল, আইড় ও চিতল। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে রয়েছে পারসে, কাওয়া, মেকারেল, টুনা, পাইল্লা, ইয়েলো ক্রোকার, পমফ্রেট, বিভিন্ন সার্ডিন বা সেড, ইচরি মলার শুঁটকি, সামুদ্রিক আইড়, কালো চান্দা, কোরাল বা ভেটকি। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে মাছ উৎপাদন বাড়লেও এখনো মাছ আমদানি করতে হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হলো, দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। আবার মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। এ ছাড়া দেশে অবস্থানরত বিদেশীদের সংখ্যাও বেড়েছে। রেস্তোরাঁগুলোয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামুদ্রিক মাছ রান্না করা হয়। এজন্য এখনো মাছ আমদানি অব্যাহত রয়েছে, তবে তা তুলনামূলক কম।
অন্যদিকে দেশে চাহিদা মিটিয়ে মাছ বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। জানা গেছে, ২০১৬-১৭ সালে ৬৮৩০৫ দশমিক ৬৮ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭৩ হাজার ১৭১ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা আয় হয়েছে, যদিও এটি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা কম।
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক দশকে দেশে চাষ করা মাছে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে। শিং, মাগুর, পাবদার মতো আরও বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ হারিয়ে যেতে বসেছিল। গবেষণার মাধ্যমে এই জাতের মাছ এখন চাষ হচ্ছে। চাষ করা মাছ থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপাদন হয়। সাগরে মাছ ধরার নতুন নতুন সরঞ্জাম কেনা হলে মাছ উৎপাদন বেড়ে যাবে। ওই সব যন্ত্রের মাধ্যমে কোন এলাকায় বেশি মাছ আছে তা নিশ্চিত হওয়া গেলে সাগর থেকে মৎস্য আহরণ আরও বেড়ে যাবে। তাতে সার্বিকভাবে মৎস্য উৎপাদন আরও বাড়বে।
বিশ^ব্যাংকের মতে, মিঠাপানির মাছ আহরণ ও চাষে বাংলাদেশের এই সাফল্য এসেছে অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে। মৎস্য চাষে বাংলাদেশে কিছু ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। দেশের ১২ শতাংশ মানুষ মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত হলেও এই খাতে আর্থিক প্রণোদনা পান শুধু রফতানিকারকরা। চাষীরা তেমন কোনো সরকারি সহযোগিতা পান না। সামগ্রিকভাবে মৎস্য খাত কৃষির আওতায় পড়ে। কিন্তু মৎস্য চাষীরা কৃষি ঋণের মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পান। ধান ও অন্যান্য ফসল চাষের জন্য কৃষকরা ডিজেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি পান। মাছ চাষীরা তা পান না। আরেকটি সমস্যা এ খাতের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। মাছের খাবার ও অন্যান্য উপকরণ খরচের বিপরীতে যে দামে চাষীরা মাছ বিক্রি করেন তাতে তাদের লাভ তো দূরে থাক, অনেক ক্ষেত্রে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এসব সমস্যা দূর করা গেলে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন আরও বেড়ে যাবে এবং ভবিষ্যতে এখাত থেকে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে।
এফএন/এমআর