ঢাকা সাগরকন্যা অফিস॥
দিন দিন বেড়েই চলেছে ধান উৎপাদনের খরচ। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, ধান বিক্রি করে কৃষক উৎপাদন খরচই তুলতে পারছে না। বরং প্রতি বছরই অব্যাহতভাবে ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষক। পাশাপাশি রয়েছে ধান উৎপাদনে কৃষি শ্রমিকের চরম সঙ্ক, মজুরি বৃদ্ধি, বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, ফড়িয়া, পাইকার, মজুদদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট, সুদখোর এনজিওদের যাতাকলে পিষ্ট হওয়া। তার সাথে রয়েছে ভারত থেকে চাল আমদানি, জলবায়ুর পরিবর্তনের ঝুঁকি। এসব কারণে কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বরং দিন দিন তারা লাভজনক ফসল উৎপাদনেই বেশি আ্গ্রহী হয়ে উঠছে। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা এমন প্রবণতাকে ভালো লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করছেন না। বরং অদূর ভষ্যিতে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে দেশে ক্রপিং জোন ও বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে না তুললে শুধু ধান নয়, সামগ্রিক কৃষির জন্য তা হবে অশনি সঙ্কেত। কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশে মোট আবদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ ৭৭ হাজার ৫শ’৫৬ হেক্টর। আর কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৭৬ লাখ ৮শ’৪টি। তাদের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক। বছরে বোরো, আউশ ও আমন মৌসুমে দেশে চাল উৎপাদন হয় মোট সাড়ে ৩ কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি। গত বোরো মৌসুম থেকে মূলত কৃষকরা ধান উৎপাদনে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। বোরো ধানের মূল্য নিয়ে দেশব্যাপী হৈ চৈ হয়। উৎপাদন খরচ না উঠায় কৃষকের মন ভেঙে যায়। যার রেশ পড়েছে আউশ এবং আমনে। চলতি আমন আবাদ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ধান উৎপাদনের শীর্ষ এলাকা দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, যশোর, মনময়সিংহ ও বরিশালসহ সারাদেশেই আমন আবাদ কমেছে। এবার রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৫ লাখ ৪৯ হাজার ২শ’ ১৯ হেক্টর। এ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৫০ লাখ ৭শ’ ২৩ হেক্টর। বোনা আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৩ লাখ ২৩ হাজার ৭শ’ ২৭ হেক্টর।
সুত্র জানায়, দেশের ৬৪টি জেলা, ৪শ’ ৮৫টি উপজেলা ও ১২ হাজার ৬শ’ ৪০টি ব্লক রয়েছে। প্রায় সবখানেই কৃষকদের অনেকেই নিজেদের উদ্যোগে ধান আবাদ ছেড়ে লাভজনক অন্যান্য ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অবশ্য মাঠপর্যায়ের কৃষি কমকর্তারাও প্রায় সবখানেই ধান উৎপাদন কমিয়ে বাণিজ্যক কৃষির উপর জোর দিতে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছে। কৃষকরাও ফসল উৎপাদন কৌশল পাল্টে ধানের বদলে উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে মাল্টা, বারোমাসী আম, টমেটো, তরমুজ, পেয়ারাসহ ফল ও সবজি আবাদে জোর দিয়েছে। মূলত অতিরিক্ত খরচ করে ধানের মূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা ধান উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তাছাড়া সরকারিভাবে যে ধান সংগ্রহ করা হয়েছে, সেখানেও প্রকৃত কৃষক ধান সরবরাহ করতে পারেনি। বরং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ধান সরবরাহ করেছে অন্য আরেকটি পক্ষ।
সূত্র আরো জানায়, সামগ্রিকভাবে দেশে কৃষির উন্নয়ন ঘটেছে। উফশী জাতের ধান চাষে ফলন বেশি হলেও সার ও সেচের খরচ অনেক বেশি পড়ে। বোরো মৌসুমে (যেটা শীতকালে রোপণ করা হয়) ধানের চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। ফলনও হয় বাম্পার। কিন্তু ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিয়ে কৃষক বারবার হতাশ হচ্ছে। সেজন্য পরিকল্পনা করে যে এলাকায় যে ফসলে কৃষকও লাভবান হয় সে বিষয়ে ক্রপিং জোন করা দরকার। একইসাথে বাজার ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা জরুরি। মূলত জোতদাররা চাষাবাদ করে খুব কম। বেশিরভাগ আবাদ করে প্রান্তিক ও বর্গা চাষিরা। ধান চুক্তিতে আবাদ করে ধান কাটা হলে মাঠ থেকেই লাভ লোকসানের হিসাব না করেই জোতদাররা ভাগটা নিয়ে নেয়। তাতে ভাড়ায় নেয়া জমিতেও প্রান্তিক ও বর্গা চাষিরা লাভ করতে পারছে না। তারা সরকারি প্রণোদনা পায় না। কারণ জমিজমার কাগজ তাদের কাছে থাকে না। এ কারণে তাদের ব্যাংক ঋণও জোটে না। পাশাপাশি জলবায়ুর পরিবর্তনেও ধান আবাদ কমার আরেকটি কারণ। ফলে কৃষকরা অন্য লাভজনক ফসল উৎপাদনের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ছে।
এদিকে দেশের সবখানেই কমবেশি ধান আবাদ কমছে। কৃষকের ছেলে কৃষক হওয়ার হার এখন সর্বনি¤œ। কৃষি শ্রমিকরাও অন্য পেশায় যুক্ত হয়ে লাভবান হচ্ছে। যার কারণে কৃষি শ্রমিক সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আর যা পাওয়া যাচ্ছে মজুরিও অত্যধিক। জমিচাষ, বীজ, চারা লাগানো, পরিচর্যা, সার, কীটনাশক, সেচ, ধান কাটা ও মাড়াইসহ প্রতি বিঘায় উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। কৃষকরা সাধারণত এক ফসলের অর্থ দিয়ে পরবর্তী ফসল আবাদ করে থাকে। কিন্তু ধান আবাদ করে কৃষকের উৎপাদন খরচই উঠছে না। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ধান উৎপাদন করে কৃষক বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চালকল মালিক, ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিকই লাভবান হন। বাজারে চালের দাম কম নয়। কিন্তু কৃষকের ধানের দাম নেই। তাছাড়া সরলতার সুযোগ নিয়ে সুদখোর ও দাদন ব্যবসায়ী এবং এনজিও ঋণের জালে পড়াও কৃষকের ধান আবাদে অনাগ্রহের অন্যতম কারণ। অথচ দেশে ধানসহ কৃষিজাত পণ্যের বিক্রয়মূল্য তদারকির ব্যাপারে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই।
এদিকে কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনরাত পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করে যদি মূল্য না পায়, উৎপাদন খরচ না ওঠে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই কৃষক মুখ ফিরিয়ে নেবে। ধানের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে আশানুরূপ উন্নতি হলেও ফুড ম্যানেজমেন্ট ও আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেনি। যার জন্য কর্মবীর কৃষকরা প্রায়ই উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিশেষ করে ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর এর মাত্রা বেশি বাড়লে অদুর ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা থাকবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. আব্দুল মুঈদ জানান, কৃষি সম্প্রসারণ ও উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেকদুর এগিয়ে গেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কৃষকের সংখ্যা ৩ শতাংশ। ফসল আবাদের ক্ষেত্রে সিলিং করে দেয়ার সুযোগ আছে। তাতে তারা যে ফসলের মূল্যে লাভবান হবেন সেই ফসল আবাদ করতে পারেন। সেখানে লোকসান হয় না বললেই চলে। বাংলাদেশে কৃষকের সংখ্যা ৬৫ শতাংশ। বিদেশীদের মতো চাষাবাদের কন্ট্রোল করা ডিফিকাল্ট। একথা তো সত্যি ধানের বদলে সবজি, মাল্টা ও ভুট্রায় ডাইভারসিটিতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। সামগ্রিক কৃষিতে বাংলাদেশ বিরাট সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে ধান আবাদ কিছুটা কমেছে। ধানের ক্ষেত্রে কৃষকের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তির বিষয়টিতে নজর দেয়া উচিত।
এফএন/এমআর